ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

বিটিসিএলের ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্প 

আবারও সক্রিয় পুরনো সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ২০:৩১, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আবারও সক্রিয় পুরনো সিন্ডিকেট

বিটিসিএল

  • সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে শুরুতে জেডটিইকে এই প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয়
  • টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মানসম্মত সরঞ্জাম সরবরাহ করেনি প্রতিষ্ঠানটি
  • বিটিসিএলের সব প্রকল্প ও কার্যাদেশ ঘিরে অবৈধ সিন্ডিকেটের দাপট, নেতৃত্বে সাবেক মন্ত্রী

 ডিজিটাল কানেকটিভিটি প্রক্রিয়াকে আধুনিকায়ন ও গতিশীল করতে মডার্নাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশনস নেটওয়ার্ক (এমওটিএন) প্রকল্প গ্রহণ করে গত আওয়ামী লীগ সরকার। তবে সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে জেডটিইকে এই প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয়। ফলে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে শুরুতেই এই প্রকল্প বড় বাধার মুখে পড়ে। পছন্দের কোম্পানি হিসেবে জেডটিই অস্বাভাবিক দর প্রস্তাব করায় এ নিয়ে সে সময় ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। 

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আসাদুজ্জামান চৌধুরী সে সময় এমওটিএন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। এই প্রকল্পে সে সময় ব্যাপক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ঘটনা ঘটে যাতে সরাসরি যুক্ত ওই সময়কার দাপুটে এই এই কর্মকর্তা। সে সময় জেডটিই টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মানসম্মত সরঞ্জাম সরবরাহ করেনি। বরং সরবরাহকৃত সরঞ্জাম ছিল অত্যন্ত সস্তা ও নিম্নমানের। এমনকি সে সময় প্রকল্প পরিচালক এ বিষয়ে তার সহকর্মীদের এ বিষয়ে কোনো কথা না বলার জন্য এবং সঠিক প্রভিশনাল একসেপ্টটেন্স টেস্ট বা পিএটি ছাড়ায় জেডটিইকে সবধরনের পেমেন্ট পরিশোধ করার জন্য চাপ দেন। 

প্রকল্প পরিচালকের সহযোগিতায় সে সময় ওই প্রকল্পে আন্ডারগ্রাউন্ড কপার ও ওএফসি ক্যাবল ঠিকভাবে সরবরাহ করেনি জেডটিই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিটিসিএলের সব প্রকল্প ও কার্যাদেশ ঘিরে ৬ বছর ধরে একটি শক্তিশালী অবৈধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের (পিটিডি) অধীন প্রতিষ্ঠানে সব অনিয়ম ঘটেছে সাবেক এক মন্ত্রীর নেতৃত্বে। এই সিন্ডিকেট টেন্ডারবাজি করে ও প্রকল্পের তহবিল চুরি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। গত কয়েক বছরে এই সিন্ডিকেটকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঘুষ বা আর্থিক সুবিধা না দিয়ে কেউ বিটিসিএল থেকে কার্যাদেশ বা টেন্ডার পেতে সক্ষম হয়নি। 

জানা যায়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের (পিটিডি) সাবেক সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান এই সিন্ডিকেট ও কারসাজিকারীদের চিহ্নিত করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন। তার এই উদ্যোগের কারণে ‘ফাইভজি এর জন্য বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের উন্নয়ন’ প্রকল্পটি কোনো ধরনের ঘুষ ছাড়া বাস্তবায়নে প্রক্রিয়াধীন একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়। নিয়ম অনুযায়ী, প্রকল্পের দরপত্র বিজ্ঞপ্তিটি ২০২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয় এবং একই বছরের ২০ ডিসেম্বর পিপিআর-২০০৮ এর নিয়ম (৭) অনুযায়ী তিন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত টেন্ডার ওপেনিং কমিটি টেন্ডারটি খোলেন। 

এতে দেখা যায়, নকিয়া, হুয়াওয়ে এবং জেডটিই কর্পোরেশন, এই তিনজন দরপত্র জমা দেয়। পিপিআর-২০০৮ এর নিয়ম (৮) অনুসরণে বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে একটি মূল্যায়ন কমিটি গঠিত হয়। বুয়েট, পুলিশ, টেলিকম এবং মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রকল্প প্যাকেজ জিডি-১ এর জন্য সাত সদস্যের সমন্বয়ে এ কমিটি গঠিত হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কারিগরি মূল্যায়নে অংশগ্রহণকারী তিনজন দরদাতাকে প্রযুক্তিগতভাবে যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে। আর্থিক দরপত্র উন্মোচনের পরে দেখা যায়, হুয়াওয়ে ৩২৬ কোটি টাকা দর জমা দেয় যা ছিল সর্বনিম্ন। 

এর ফলে বিটিসিএল আনুমানিক খরচ থেকে ১৩৭ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা, জেডটিই ৪১৫ কোটি টাকা ও তৃতীয় দরদাতা নকিয়া ৫৭৯ কোটি টাকা প্রস্তাব করে। কিন্তু আর্থিক দরপত্র উন্মোচনের আগেই অংশগ্রহণকারী তিন দরদাতা যোগ্য বিবেচিত হওয়ায় ওই সিন্ডিকেট বুঝে গিয়েছিল তাদের সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান কাজটি পাবে না। যে কারণে তারা এই দরপত্র বাতিল করতে সবধরনের অপচেষ্টা করেন। 

সে সময় প্রকল্প কার্যালয় প্রধান (হোপ) অর্থাৎ বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আসাদুজ্জামান চৌধুরী আর্থিক দরপত্র খোলা নিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি) থেকে কারিগরি প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিটিসিএল বা হোপ দুই দরদাতা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ব্যাখ্যা চান। তবে টিইসির পক্ষ থেকে ওই বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও কোনো ধরনের যৌক্তিক কারণ ছাড়ায় সেটি প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। বরং দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরদাতা প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা সনদের বিষয়ে টিইসির কাজ থেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা চান। এমনকি টিইসির পক্ষ থেকে স্পষ্টীকরণের সঠিক ব্যাখ্যা ও দরপত্রের প্রাসঙ্গিক কমপ্লায়েন্স ইস্যু উল্লেখ করে প্রতিবেদন সরবরাহ করা হলেও, তিনটি প্রতিষ্ঠানের দেয়া দরপত্র প্রস্তাব বাতিল করে হোপ।   

বিটিসিএলের ২১৩তম বিওডি সভায় হোপের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয় এবং হোপকে বিষয়টি সমাধনের জন্য বলা হয়। তবে বিষয়টি সমাধান না করে সে সময় হোপ বা বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আসাদুজ্জামান চৌধুরী ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট প্রথম ও দ্বিতীয় দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য ঘোষণা করতে আরেকটি নতুন অযৌক্তিক কারণ উত্থাপন করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এমন বৃহৎ দরপত্রের ক্ষেত্রে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো এখতিয়ার হোপের নেই। সর্বোচ্চ ১৫ কোটি টাকার দরপত্র পর্যন্ত তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। 

সবশেষ সেন্ট্রাল প্রকিওরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) রিভিউ প্যানেল সবগুলো দরদাতা প্রতিষ্ঠানকেই যোগ্য বলে ঘোষণা করে এবং আসাদুজ্জামান চৌধুরী দোষী সাব্যস্ত হন। পরবর্তীতে তিনি এই ইস্যুটি নিয়ে হাইকোর্টে একটি মামলা করেন। যদিও আদালত বিটিসিএলকে সিপিটিইউ রিভিউ প্যানেলের রায় অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। 

অন্যদিকে সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই এই দরপত্র বাতিল করার চেষ্টাকে প্রশ্রয় দেন। নিয়মভঙ্গ করে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল বানোয়াট অভিযোগ তুলে সরাসরি মন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। দরপত্র বাতিল ও নতুন করে দরপত্র আহ্বান করানোর জন্য সরঞ্জামের কারিগরি সক্ষমতা নিয়ে বানোয়াট তথ্য দিয়ে ওই চিঠি লেখা হয়। 

পরে মোস্তাফা জব্বার প্রকল্প পরিচালককে স্পেসিফিকেশন পরীক্ষা করার জন্য চিঠি পাঠান। যদিও প্রথমে তিনিই এই প্রকল্প ও এর স্পেসিফিকেশনের অনুমোদন দিয়েছিলেন। তবে হঠাৎ করে তিনি দরপত্রের স্পেসিফিকেশন পুনরায় মূল্যয়ন করার জন্য কমিটিকে ফরওয়ার্ডিং লেটার পাঠান। 
তবে সব রায় পক্ষ থাকায় ওই দরপত্র বাতিল হয়নি এবং বিটিসিএল সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে হুয়াওয়েকে কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ এর ফলে অনুমোদিত ব্যয় থেকে ১৩৭ কোটি টাকা সরকারের সাশ্রয় হয়। সবশেষ ২০২৩ সালের নভেম্বরে বিটিসিএল ও হুয়াওয়ের মধ্যে এ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। 

এই প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে এবং বাকি কাজ আগামী ছয় মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রকল্পটি সম্পূর্ণ হলে ফোরজি এবং আসন্ন ফাইভ জি প্রযুক্তির পরিষেবাগুলো নিশ্চিতে বৃহত্তম ট্রান্সমিশন ব্যাকবোন নেটওয়ার্ক প্রস্তুত হবে যার সুবিধা টেলিকম অপারেটর যেমন টেলিটক, জিপি, রবি, বাংলালিংক এবং অন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও পাবে। এটি আসন্ন যে কোনো সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যান্ডউইথ বহন করতেও সক্ষম হবে। 

এটা বিটিসিএলের রাজস্ব বাড়াতেও বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। অন্যান্য দেশ ফাইভজি সেবা চালু করলেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পাঁচ বছর পিছিয়ে গেছে। তবে এই প্রকল্প চালু হলে বাংলাদেশে ফাইভজি প্রযুক্তি চালুতে এটি সাহায্য করবে। কিন্তু প্রকল্প বাতিল করে প্রবৃদ্ধি নষ্ট করতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে পুরনো সিন্ডিকেট। 

সাম্প্রতিক উদ্যোগ হিসাবে, একই সিন্ডিকেট কয়েকটি গণমাধ্যমে ভুয়া খবর প্রকাশ করছে, গুজব ছড়াচ্ছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে বিভ্রান্ত করতে এবং পুরো প্রক্রিয়াটি বাতিল করতে কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করছে। অনেক চ্যালেঞ্জের পর অবশেষে যখন এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখছে তখন নতুন প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, এর ভবিষ্যৎ কী হবে? সেটা এখনো অনিশ্চিত।

রহিম

×