ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১

পাহাড়-পর্বত কি স্থির নাকি নড়াচড়া করে? কোরআন থেকে পাওয়া তথ্য

প্রকাশিত: ০১:৫৬, ২৬ মার্চ ২০২৫

পাহাড়-পর্বত কি স্থির নাকি নড়াচড়া করে? কোরআন থেকে পাওয়া তথ্য

ছবি: সংগৃহীত।

বিশ্বের জ্যামিতিক সৌন্দর্যের মধ্যে পাহাড়-পর্বত এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশাল আকারের পাহাড় আর পর্বত দেখলে যে কারোরই মনে হবে এগুলো যেন স্থির এবং অচল। শক্তিশালী এসব পর্বতগুলো যে এক চুল পরিমাণ নড়াচড়া করতে পারে, এমন ধারণাও কারো মাথায় আসবে না। অথচ আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মহান আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারীমের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলেন, "মেঘ যেমন চলাচল করে, পর্বতগুলো ঠিক তেমনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরে যায়।"

এই তথ্যটি কিছুদিন আগ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, বিজ্ঞানীদের কাছেও ছিল এক বিস্ময়কর ধারণা। কিন্তু আজকের বিজ্ঞানে তা প্রমাণিত হয়েছে। সূরা আন-নামল এর 88 নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, "তুমি পর্বতমালাকে দেখে অচল মনে করো, অথচ সেদিন এগুলো মেঘমালার মতো চলমান হবে। এটা আল্লাহর কারিগরি, যিনি সবকিছুকে করেছেন সুসংহত। তোমরা যা কিছু করছো, তিনি তা অবগত আছেন।"

মুফাসসিরগণ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এটি কেয়ামতের দিনের কথা বলা হয়েছে। সেদিন ইসরাফিলের প্রথম ফুৎকারের সাথে সাথে পাহাড়সমূহ স্থানচ্যুত হয়ে মেঘমালার মতো চলমান হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই আয়াত কি শুধু একটি উপমা, নাকি এখানেও কোনো বৈজ্ঞানিক আভাস আছে? দর্শক, চলুন একটু গভীরে গিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। মহান আল্লাহ তাআলা কোরআনে এমন কোনো দৃষ্টান্ত দেননি যা মানুষ বুঝতে পারবে না। এই আয়াতেও আল্লাহ তাআলা পর্বতের যে কথা বলেছেন, তা তখনকার মানুষের জন্য ছিল এক অসাধারণ এবং রহস্যময় ধারণা। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে ভূতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করেছেন, পর্বতগুলো একেবারেই স্থির নয়, বরং এগুলো ধীরে ধীরে তার নিজ স্থান থেকে সরে যাচ্ছে। একইভাবে সাগরের তলাও গতি নিয়ে চলছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগনার দাবি করেন, পৃথিবীর মহাদেশগুলো যখন প্রথম গঠিত হয়েছিল, তখন একত্রিত ছিল। পরে তারা বিভিন্ন দিকে সরে গিয়ে একে অপর থেকে আলাদা হয়ে যায়। তৎকালীন ভূতাত্বিকরা প্রথম দিকে এর বিরোধিতা করলেও, ওয়েগনারের মৃত্যুর ৫০ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৮০-এর দশকে তারা বুঝতে পারেন, ওয়েগনারের দাবিটি সঠিক ছিল।

ওয়েগনার ১৯১৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, পৃথিবীর মহাদেশগুলো প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে একত্রিত ছিল, এবং এই বৃহৎ ভরটিকে "প্যাঞ্জিয়া" বলা হতো, যা দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত ছিল। প্যাঞ্জিয়া বিভক্ত হওয়ার পর থেকেই এই মহাদেশগুলো পৃথিবীর পৃষ্ঠে প্রতিবছর কয়েক সেন্টিমিটার হারে চলমান রয়েছে এবং একই সাথে পৃথিবীর সাগর এবং স্থলভাগের অনুপাত পরিবর্তিত হয়েছে। ভূগোলে এটি কন্টিনেন্টাল ড্রিফট থিওরি নামে পরিচিত।

২০ শতকের শুরুতে এসে ভূতাত্ত্বিক গবেষণা জোরে সোরে শুরু হয়। এতে দেখা যায়, পৃথিবীর পৃষ্ঠে ছয়টি বড় প্লেট এবং অসংখ্য ছোট প্লেট রয়েছে, যা একে অপরের সাথে ধাক্কা খায়, সরে যায় বা পরস্পরের নিচে চলে যায়। এটি প্লেট টেকটনিক নামে পরিচিত, যার মাধ্যমে মহাদেশ এবং সমুদ্রতলকে একত্রে সরানো হয়। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, মহাদেশের এই সরে যাওয়ার গতির হার প্রতিবছর এক থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই প্লেটগুলো এভাবে চলার কারণে পৃথিবীর ভৌগোলিক চিত্রেও পরিবর্তন ঘটে।

প্লেট টেকটনিক্স তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, পর্বতগুলোর সৃষ্টি এবং তাদের গতির পেছনে রয়েছে এই প্লেটগুলোর মুভমেন্ট। যেমন, হিমালয় পর্বতমালা আজও পরিবর্তিত হচ্ছে, কারণ ভারতীয় প্লেট এশিয়ান প্লেটের দিকে ধাক্কা দিচ্ছে। এই ধাক্কা থেকে হিমালয়ের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রতিবছরই কয়েক সেন্টিমিটার হারে এর পরিবর্তন ঘটছে। এটি পর্বতের চলমান হওয়ার একটি বাস্তব প্রমাণ।

টেকটনিক প্লেটের এমন পরিবর্তনের কারণে শুধু পাহাড় আর পর্বত নয়, বরং সাগরের সীমানাও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন, আটলান্টিক মহাসাগর প্রতিবছর বিস্তৃত হচ্ছে, কারণ ইউরেশিয়ান এবং উত্তর আমেরিকান প্লেট একে অপর থেকে সরে যাচ্ছে।

মহান আল্লাহ তাআলা সূরা নামল-এর এই আয়াতে যে "তামুরু" শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তার অর্থ "ভেসে চলা", যে শব্দের মাধ্যমে পর্বতের চলাচলের কথা বর্ণিত হয়েছে। এদিকে আজকের ভূতত্ববিদরা এই টেকটনিক প্লেটের বিষয়টি বোঝাতে যে শব্দটি ব্যবহার করছেন, তা হলো "কন্টিনেন্টাল ড্রিফট", যার অর্থ "মহাদেশের ভেসে চলা", যা কোরআনে বর্ণিত শব্দের সাথে হুবহু মিলে যায়। উভয় ক্ষেত্রেই মহান আল্লাহ তাআলা এবং বিজ্ঞানীরা পর্বতের এই মুভমেন্টের কথা বর্ণনা করতে গেয়ে "ভেসে চলা" বা "ড্রিফটিং" শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা তার নিজের নিখুঁত কারিগরির কথা উল্লেখ করে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহ তাআলা তার অসীম জ্ঞান এবং শক্তির মাধ্যমে পৃথিবী এবং এর উপাদানগুলোকে সুবিন্যস্ত করেছেন। পর্বতের ভেসে চলার তথ্য দিয়ে মহান আল্লাহ প্রমাণ করে দিয়েছেন, তোমরা যতই অনুসন্ধান করবে, ততই নতুন নতুন রহস্য উন্মোচিত হবে।

নুসরাত

×