
ইতেকাফ ইসলামে একটি ফজিলতপূর্ণ আমল। মসজিদে দুনিয়াবি কাজকর্ম থেকে অবসর নিয়ে সওয়াবের নিয়তে এক বা একাধিক দিন অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। ইতেকাফের বিধান অনেক পুরোনো।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে নির্দেশ দিলাম, তোমরা আমার ঘরকে তওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু–সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। (সুরা বাকারা: ১২৫)
রমজান মাসের শেষ দশকের ইতেকাফ মূলত পুরুষদের জন্য, যা মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু নারীদের জন্যও ইতেকাফের বিধান রয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) মৃত্যু পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীরাও ইতেকাফ করেছেন।’ (বুখারি: ২০৩৬)
নারীরা ঘরে ইতেকাফ করবেন। তাদের জন্য ইতেকাফ করা মুস্তাহাব। নারীরা ইতেকাফের স্থান পর্দা দিয়ে ঢেকে নেবেন। যেন কোনো বেগানা পুরুষ এলে তাদের স্থান পরিবর্তন করতে না হয়।
ফতোয়ার কিতাবে বলা হয়েছে, নারীরা ঘরে তাদের নামাজ আদায়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে ইতেকাফ করবেন। যদি আগে থেকেই ঘরে নামাজের জন্য কোনো স্থান নির্ধারিত না থাকে তাহলে ইতেকাফের জন্য একটি স্থান নির্ধারিত করে নেবেন। এরপর সেখানে ইতেকাফ করবেন। (উমদাতুল কারি: ১১/১৪৮; হেদায়া: ১/২৩০; বাদায়েউস সানায়ে: ২/১১৩)
বিবাহিত নারী ইতেকাফ করতে চাইলে স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া ইতেকাফ করা অনুচিত। আর স্বামীদের উচিত, যুক্তিসংগত ও গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া স্ত্রীদের ইতেকাফে বাধা না দেওয়া। তাদের ইতেকাফের সুযোগ করে দেওয়া। এতে উভয়ই সওয়াব পাবেন। (রদ্দুল মুহতার: ২/৪৪১; ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ১/২১১) স্বামী স্ত্রীকে ইতেকাফের অনুমতি দেওয়ার পর আর বাধা দিতে পারবেন না। বাধা দিলেও সে বাধা গ্রহণযোগ্য নয় এবং স্ত্রীর জন্য তা মানাও জরুরি নয়। (রদ্দুল মুহতার: ২/৪৪১; ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ১/২১১)
ঋতুস্রাব অবস্থায় ইতেকাফ সহিহ হয় না। কেননা এ অবস্থায় রোজা রাখা যায় না। আর সুন্নত ইতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। নারীদের ইতেকাফে বসার আগেই তাদের ঋতুস্রাবের দিন-তারিখ হিসাব করে বসা উচিত। যাতে ইতেকাফ শুরু করার পর পিরিয়ড শুরু হয়ে না যায়। তবে কারও রমজানের শেষ দশকে পিরিয়ড হওয়ার নিয়ম থাকলে তিনি পিরিয়ড শুরু হওয়া পর্যন্ত নফল ইতেকাফ করতে পারবেন। ইতেকাফ অবস্থায় ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেলে ইতেকাফ ভেঙে যাবে। পরে শুধু এক দিনের ইতেকাফ রোজাসহ কাজা করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৭৪; ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ১/২১১)
নারীরা ঘরের যে স্থানটিকে ইতেকাফের জন্য নির্ধারিত করবেন তা তাদের ক্ষেত্রে মসজিদের মতোই গণ্য হবে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া তারা সেখান থেকে বের হতে পারবেন না। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া সে স্থানের বাইরে ঘরের অন্যত্র গেলেও ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ১/২১১; বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৮২)
নারীরা ইতিকাফ অবস্থায় ঘরের নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থান থেকে প্রস্রাব-পায়খানার জন্য বের হতে পারবেন। ওজুর জন্যও বাইরে যেতে পারবেন। খাবার পৌঁছে দেওয়ার লোক না থাকলে খাবার আনার জন্য বাইরে যেতে পারবেন। (বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৮২, হেদায়া: ১/ ২৩০; শামি: ৩/৪৩৫) পানাহার ইতেকাফের জায়গায় করতে হবে। বাইরে করা যাবে না। (হেদায়া: ১/২৩০)
ইতেকাফের জায়গায় থেকে অন্যদের সাংসারিক কাজের ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া যাবে। বাইরে যাওয়া যাবে না। রান্না-বান্নার লোক না থাকলে ইতেকাফের স্থানে থেকে রান্না -বান্নার কাজ সম্ভব হলে করা যাবে। (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া: ১৫/৩৩৪)
দুনিয়াদারির ঝামেলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়া এবং বিনয় ও নম্রতায় নিজেকে আল্লাহর দরবারে সমর্পণ করা, বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করার সুযোগ লাভ করাই ইতেকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) রমজানের প্রথম ১০ দিন ইতেকাফ করেছেন। অতঃপর মধ্যবর্তী ১০ দিন ইতেকাফ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন, আমি লাইলাতুল কদরের তালাশে ইতেকাফ করেছি। আমাকে বলা হলো, লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকে। অতএব, কেউ ইতেকাফ করতে চাইলে সে ইতেকাফ (শেষ দশকে) করতে পারে। ফলে লোকজন তাঁর সঙ্গে ইতেকাফ করল। (মুসনাদে আহমদ: ১১৭০৪)
ইতেকাফের ফজিলত নিয়ে অনেক হাদিস রয়েছে। এক হাদিসে নবী (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক দিন ইতেকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন পরিখা পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করবেন; যার দূরত্ব দুই দিগন্তের দূরত্বের থেকে বেশি দূরত্ব হবে।’ (কানজুল উম্মাল: ২৪০১৯)
ইতেকাফকারী দুই হজ ও দুই ওমরার সাওয়াব পাবেন। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে দশ দিন ইতেকাফ করবে তার আমল দুই হজ ও দুই ওমরার সমতুল্য’ (শুআবুল ইমান: ৩৬৮১; কানজুল উম্মাল: ২৪০০৬)
ইতেকাফ অবস্থায় কেউ যদি রাতে ঘুমিয়েও থাকে, তবু তাকে ইবাদতকারীদের মধ্যে শামিল করা হবে। তখন শবেকদরের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদতে ব্যয় করার ফজিলত অর্জন করবেন। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, في المعتكف هو يعكف الذنوب و يجري له من الحسنات كعامل الحسنات كلها ‘সে নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকী তার জন্য লেখা হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
সজিব