
মাহে রমজান পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস। এই মাসে অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করা ও কোরআন খতমের চেষ্টা করা মোস্তাহাব। তবে তা ফরজ নয়। অর্থাৎ রমজানে কোরআন খতম না করলে গুনাহ হবে না। তবে অনেক সওয়াব থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
রমজানে নবীজির কোরআন খতম
মহানবী (স.) রমজান মাসে অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং জিবরাইল (আ.)-কে তা শোনাতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রমজান মাসের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে উপস্থিত হতেন এবং তাঁরা উভয়েই পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (বুখারি: ৬) হজরত ফাতেমা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রতি রমজানে রাসুল (স.) জিবরাইল (আ.)-কে একবার কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। কিন্তু মৃত্যুর বছর তিনি তাকে দু’বার কোরআন শোনান।’ (সহিহ বুখারি: ৬২৮৫) ইবনে কাসির (রহ) বলেন- ‘অর্থাৎ তিনি তাঁকে যতটুকু কোরআন নাজিল হয়েছে ততটুকু পাঠ করে শুনাতেন।’ (আল-জামে ফি গারিবিল হাদিস: ৪/৬৪)
নবীজির সাহাবিদের অবস্থাও ভিন্ন ছিল না। রমজান এলে তাঁরা তেলাওয়াতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। বছরের অন্যান্য সময় যতদিনে কোরআন খতম করতেন, রমজানে তার চেয়ে কম সময়ে কোরআন খতম করতেন। পাশাপাশি তারাবি এবং কিয়ামুল লাইলে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কোরআন তেলাওয়াতের আমল জারি থাকত। সলফে সালেহিন এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদিনের জীবনীতেও এমনটাই চোখে পড়ে। মাহে রমজানে তাঁরা সকলেই কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন।
রমজানে কোরআন খতমের সহজ পদ্ধতি
কাজের চাপ থাকলে এবং কোরআন নিয়ে দীর্ঘ সময় বসার সুযোগ না পেলে রমজানে প্রতিদিন একটি রুটিন তৈরি করে নিতে পারেন। রুটিন অনুযায়ী প্রত্যেক নামাজের পর চার পৃষ্ঠা করে কোরআন তেলাওয়াত করুন। এতে প্রতিদিন পাঁচ বার চার পৃষ্ঠা তেলাওয়াতের ফলে একদিনে এক পারা শেষ হবে। ফলে মাসের শেষে দেখা যাবে পুরো কোরআন এক খতম হয়ে গেছে। এভাবে একাধিক খতম করতে চাইলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে ও পরে হিসেব অনুযায়ী পৃষ্ঠা ভাগ করে নিলে পুরো রমজানে একাধিকবার কোরআন খতম দেওয়া সম্ভব।
রমজানে কোরআন খতম করা মোস্তাহাব
পবিত্র রমজানে কোরআন তেলাওয়াত ও কোরআন খতম করার এতো তাগিদ ও এত গুরুত্বের পরেও সেটা মুস্তাহাব পর্যায়ে। এটি জরুরি বা ফরজ পর্যায়ের নয় যে, না করলে গুনাহগার হতে হবে। শাইখ উসাইমিনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:- রোজাদারের উপর কুরআন খতম করা কি ফরজ? জবাবে তিনি বলেন, ‘রমজান মাসে রোজাদারের জন্য কোরআন খতম করা ফরজ নয়। তবে ব্যক্তির উচিত রমজানে বেশি বেশি কোরআন পড়া। এটাই ছিল রাসূলের আদর্শ। গোটা রমজান মাসে জিবরাইল (আ.) নবী (স.)-এর সাথে কোরআন পাঠ করতেন। (মাজমু ফতোয়া ইবনে উছাইমিন: ২০/৫১৬)
খতম তারাবি পড়লে কোরআনের খতম পূর্ণ হয়
রমজানের কোরআন খতমের গুরুত্ব রয়েছে বিধায় বিশ্বব্যাপী খতম তারাবি পড়ানো হয়। যারা কোরআন পড়তে পারে না, তারা রমজানের প্রত্যেক রাতে খতম তারাবিতে অংশ নিলেই কোরআনের খতম সম্পন্ন হয়ে যায়।
ফতোয়াগ্রন্থে এসেছে, রমজানের প্রতি রাতে তারাবি পড়া সুন্নত। আবার তারাবিতে একবার পূর্ণাঙ্গ কোরআন খতম করা আলাদা সুন্নত। দুইবার খতম করা ভালো। তিনবার খতম করা আরও ভালো। খতম তারাবি পড়ালে মানুষ মসজিদে আসতে অলসতা করে এ অজুহাতে খতম তারাবি না পড়ানো ঠিক নয়। (ফতোয়ায়ে শামি)
ফিকহে হানাফির গ্রহণযোগ্য কিতাব মাবসুতে সারাখসিতে বলা হয়েছে, ‘তারাবিতে কোরআন খতম করা সুন্নত। এর দলিল হলো, ওমর (রা.) তিনজন ইমামকে ডেকে তাদের তেলাওয়াত শুনলেন। এরপর তাদের একজনকে প্রতি রাকাতে ৩০ আয়াত করে, দ্বিতীয় জনকে ২৫ আয়াত করে এবং অন্যজনকে ২০ আয়াত করে পড়ার নির্দেশ দিলেন। যেহেতু পুরো রমজানে ৬০০ রাকাত তারাবি পড়া হয় এবং কোরআনের আয়াত সংখ্যা ছয় হাজারের কিছু বেশি, সেহেতু প্রতি রাকাতে ১০ আয়াত করে পড়লেও এক খতম হয়ে যায়। আর যদি হুবহু হজরত ওমর (রা.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী পড়া হয়, তাহলে দুই-তিন বার খতম হবে।’ ইমাম কাসানি (রহ.) উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, ইমাম আবু হানিফা যেটা বলেছেন (অর্থাৎ পুরো মাসে তারাবিতে একবার কোরআন খতম করা) সেটা সুন্নত। আর ওমর (রা.) যেটা বলেছেন (অর্থাৎ একাধিকবার খতম করা) সেটা উত্তম। (বাদায়িয়ুস সানায়ে)
তবে ঠিক কত দিনে খতম শেষ করতে হবে, তা নির্দিষ্ট নয়। তিন, পাঁচ, সাত, দশ যত দিনে ইচ্ছা কোরআন খতম করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়।
১. কোরআনকে মাখরাজ, মাদ, ওয়াকফ ইত্যাদির নিয়ম অনুসরণ করে পূর্ণাঙ্গ তাজভিদ সহকারে পড়তে হবে। দ্রুত শেষ করার জন্য তাড়াতাড়ি কোরআন পড়ার চেয়ে অল্প অল্প পড়ে দেরিতে খতম শেষ করা ঢের ভালো।
২. তিন-সাত-দশ দিনের খতমে কিছু মানুষ ইমামের রুকুতে যাওয়া পর্যন্ত বসে থাকে, রুকুতে গেলে তড়িঘড়ি করে নামাজে যুক্ত হয়। এটা মারাত্মক ভুল। এভাবে খতম আদায় হয় না এবং জামাতে কোরআন শোনার সওয়াবও পাওয়া যায় না।
৩. অনেকেই খতম শেষ হওয়ার পর আর তারাবিই পড়ে না। অথচ তারাবিতে কোরআন খতম করা এবং রমজানের প্রতি রাতে তারাবি পড়া দুটি স্বতন্ত্র সুন্নত। তিন বা দশ দিনে খতম শেষ হয়ে গেলেও বাকি রাতগুলোতে তারাবি পড়তে হবে। (ফতোয়া দারুল উলুম দেউবন্দ)
সজিব