
ছবি: সংগৃহীত।
ফিরাউনকে কোরআনের সর্বকালের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি বলা হয়েছে। তবে তার স্ত্রী, আসিয়া, জান্নাতে মহান আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী স্থানে একটি ঘর লাভ করবেন। আল্লাহ তাআলা কোরআনে যেমন ফিরাউনকে অবিশ্বাসীদের জন্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তেমনি তার স্ত্রী আসিয়া কে ঈমানদারদের জন্য উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
প্রশ্ন হলো, কেন এত নিকৃষ্ট একজন মানুষের স্ত্রীকে মহান আল্লাহ এত মর্যাদা দিয়েছেন?
আসিয়া (আ.)-এর গল্প
আসিয়া (আ.)-এর গল্পের শুরু মিশর থেকে, যেখানে তিনি স্বামী ফিরাউনের সঙ্গে বাস করতেন। ধারণা করা হয়, যেহেতু তিনি ফিরাউনের স্ত্রী ছিলেন, তার বাবাও তৎকালীন মিশরের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। অর্থাৎ, আসিয়া (আ.) ছোটবেলা থেকেই ধনী পরিবারে বড় হয়েছেন এবং পরবর্তীতে মিশরের রানী হন।
তার ছিল নিজস্ব রাজ্য, নিজস্ব প্রাসাদ—কোনো কিছুর অভাব ছিল না। তবে ছিল না শুধু একটি সন্তান।
অন্যদিকে, ফিরাউনের গণকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, বনী ইসরাইলের ঘরে এমন এক সন্তান জন্ম নেবে, যে তাকে সিংহাসনচ্যুত করবে। এই কথা শুনে ফিরাউন ভয়ে বনী ইসরাইলের সব পুত্র সন্তানকে হত্যা করা শুরু করে।
মহান আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন—
"স্মরণ করো, যখন আমি তোমাদেরকে ফিরাউনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলাম, যে তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করতো এবং তোমাদের কন্যা সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতো, আর তোমাদের ওপর অত্যাচার চালাতো। বস্তুত এটি ছিল তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে কঠিন এক পরীক্ষা।"
ঠিক সে সময়ই জন্মগ্রহণ করেন মুসা (আ.)। মুসা (আ.)-এর মা ভয় পেয়ে যান, কারণ ফিরাউন যদি জানতে পারে, তাহলে তাকেও হত্যা করা হবে। আল্লাহ তাআলার নির্দেশে তিনি মুসাকে একটি ঝুড়িতে করে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। সেই ঝুড়ি ভেসে চলে যায় ফিরাউনের প্রাসাদে।
ফিরাউনের লোকেরা মুসাকে দেখে ফেললে, তাকে হত্যা করতে চায়। তখন আসিয়া (আ.) তাদের অনুরোধ করেন, যাতে তাকে হত্যা করা না হয়।
এ বিষয়ে কোরআনে বলা হয়েছে—
"ফিরাউনের স্ত্রী বলল, ‘এই শিশুটি আমার এবং আপনার জন্য চক্ষুশীতলতা হতে পারে। তাকে হত্যা করবেন না। হতে পারে, সে আমাদের কাজে আসবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করবো। অথচ তারা (ফিরাউন ও তার লোকেরা) জানতো না কী হতে চলেছে।’"
ফিরাউন তার স্ত্রীর কথা ফেলতে পারেননি এবং মুসাকে হত্যা করেননি। পরবর্তীতে, মুসা (আ.) বড় হয়ে ওঠেন আসিয়া (আ.)-এর আদর-ভালোবাসায়।
বহু বছর পর, মুসা (আ.) নবুয়ত লাভ করে আল্লাহর বাণী প্রচার করতে ফেরাউনের দরবারে আসেন এবং এক আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত দেন। ফেরাউনের পরিবারের কেউই মুসাকে বিশ্বাস করেনি, তবে আসিয়া (আ.) গোপনে ঈমান আনেন।
একদিন, ফিরাউনের আরেক স্ত্রীর মেয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলেন এক দাসী। অসাবধানতাবশত চিরুনিটি মাটিতে পড়ে গেলে দাসী বলেন, "বিসমিল্লাহ।"
ফিরাউনের মেয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কার নাম নিলে?"
দাসী উত্তর দেন, "আমি আল্লাহর নাম নিয়েছি, যিনি আমার, তোমার এবং তোমার পিতারও মালিক।"
এই কথা শুনে ফিরাউনের মেয়ে রাগ করে তার বাবাকে জানায়। তখন ফিরাউন সেই দাসীকে তার সন্তানসহ ধরে এনে বলে, "আমাকে উপাস্য মানো, নইলে তোমার সন্তানদের সামনে পুড়িয়ে দেব।"
কিন্তু সেই দাসী এক আল্লাহর প্রতি অটল থাকেন। ফলে, ফিরাউন তার সন্তানদের আগুনে পুড়িয়ে ফেলে।
এই নির্মম ঘটনা দেখে আসিয়া (আ.)-এর মন ভেঙে যায়। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন—
"আমি মুসা (আ.) ও হারুন (আ.)-এর আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি! আমি কখনোই ফিরাউনকে খোদা মানবো না।"
ফিরাউন প্রচণ্ড রেগে যান। যাকে তিনি এত ভালোবাসতেন, সেই স্ত্রী তার বিরোধিতা করলো! এরপর তিনি আসিয়া (আ.)-এর ওপর অমানবিক নির্যাতন চালান।
ফিরাউন আদেশ দেন, তাকে উত্তপ্ত মরুভূমিতে বেঁধে ফেলা হোক, খাবার ও পানি বন্ধ করে দেওয়া হোক, সম্মানহানি করে চাবুক মারা হোক।
এই নির্যাতনের মধ্যেও আসিয়া (আ.) আকাশের দিকে তাকিয়ে দোয়া করেন—
"হে আমার পালনকর্তা! আমার জন্য আপনার নিকট জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করুন। আমাকে ফিরাউন ও তার কুকর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে জালিম সম্প্রদায়ের হাত থেকে রক্ষা করুন।"
আল্লাহ তাআলা তার দোয়া কবুল করেন। তিনি আকাশ উন্মুক্ত করে আসিয়া (আ.)-কে জান্নাতে তার ঘর দেখিয়ে দেন।
জান্নাতে নিজের ঘর দেখে তিনি হাসতে শুরু করেন। এই দৃশ্য দেখে ফিরাউন বলেন, "এই মহিলার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।" এরপর আদেশ দেন, তাকে পাহাড়ের নিচে বেঁধে রাখা হোক এবং উপর থেকে পাথর ফেলে হত্যা করা হোক।
কিন্তু, পাথর তার গায়ে পড়ার আগেই আল্লাহ তাআলা তার রুহ কবজ করে নেন।
বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মানুষের স্ত্রী হয়েও, মিশরের রানী হয়েও, কোনো অভাব না থাকা সত্ত্বেও, আসিয়া (আ.) আল্লাহর পথে ঈমান এনেছিলেন। তার ধৈর্য, ঈমানদারী ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের কারণেই মহান আল্লাহ তাকে এত মর্যাদা দিয়েছেন এবং নিজের নিকট জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করে দিয়েছেন।
আসিয়া (আ.) আমাদের জন্য এক অনন্য উদাহরণ, যিনি প্রমাণ করেছেন—সত্যের ওপর অবিচল থাকলে দুনিয়ার সব নির্যাতন সইয়ে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করা সম্ভব।
নুসরাত