
ছবিঃ সংগৃহীত
নিজের বাবা, নমরুদ ও পুরো জাতির ষড়যন্ত্রে ইব্রাহিম (আ) বাবেল শহর ছেড়ে চলে গেলেন। যে বাবা তাকে আগুনে ফেলে হত্যা করতে চেয়েছিল, ইব্রাহিম (আ) সেই বাবার প্রতি কোন রাগ তো রাখলেনই না বরং তার জন্য দোয়া করলেন।
আর মহান আল্লাহ, পবিত্র কোরআনে তার এই দোয়া লিপিবদ্ধ করেন। "আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক! আমি আমার প্রতিপালকের কাছে আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। তিনি সত্যিই আমার জন্য পরম করুণাময়।" [সুরা মারিয়াম, আয়াত ৪৭]
ইব্রাহিম (আ) বাবেল শহর ছেড়ে আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী চলে গেলেন বর্তমান ফিলিস্তিনে। এরপর থেকে তার জীবনে আসা শুরু করলো একের পর এক কঠিন পরীক্ষা। কিন্ত প্রতিটি পরীক্ষাতেই ইব্রাহিম (আ) মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন। আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আ), তার স্ত্রী হাজেরা (আ) ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আ)-কে বর্তমান সৌদি আরবের মরুভূমিতে মক্কার এক নির্জন স্থানে রেখে আসেন। এটিও ছিল আল্লাহর এক মহা পরীক্ষা। তখন সেখানে কোন পানি, খাবার বা কোন বসতি ছিল না। হাজেরা (আ) বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি আমাদের এখানে রেখে যাচ্ছেন আল্লাহর আদেশে?, ইব্রাহিম (আ) মাথা নেড়ে সম্মতি দেন। তখন হাজেরা (আ) নিশ্চিন্ত হয়ে বলেন, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের পরিত্যাগ করবেন না।
ইব্রাহিম (আ) চলে যাওয়ার পর তার শিশুপুত্র ইসমাইল (আ) যখন তৃষ্ণায় কাঁদতে থাকেন, তখন হাজেরা (আ) পানি খুঁজতে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে ৭বার দৌড়ান। কিন্ত তিনি কোন সাহায্য খুঁজে পান না। তিনি ফিরে এসে দেখলেন, আল্লাহর কুদরতেই ইসমাইল (আ) এর পায়ের আঘাতে মাটি ফেটে সেখান থেকে স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ পানি বের হচ্ছে। তিনি দ্রুত সেই পানির চারদিকে পাথর দিয়ে আটকে দেন। আর এটি হচ্ছে বরকতময় জমজম কূপ। মক্কার সেই নির্জন মরুভূমিতে বড় হতে থাকলেন ইসমাইল (আ)।
যখন ইসমাইল (আ) কিশোর বয়সে উপনীত হন, তখন ইব্রাহিম (আ) স্বপ্নে দেখেন তিনি তার পুত্রকে কুরবানি দিচ্ছেন। তিনি বুঝতে পারেন, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। তিনি ইসমাইল (আ)-কে বললেন, "হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে কুরবানি করছি। এখন তোমার মত কী?" [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০২]
ইসমাইল (আ) বিনা দ্বিধায় উত্তর দিলেন, হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। ইব্রাহিম (আ) যখন তাকে কুরবানি দিতে উদ্যত হন, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক দুম্বা প্রেরিত হয় এবং ইসমাইল (আ) এর পরিবর্তে সেটি কুরবানি হয়।
আল্লাহ বলেন, "নিশ্চয়ই এটি ছিল এক মহাপরীক্ষা, আর আমি তাঁর পুত্রের পরিবর্তে এক মহান কুরবানি দিলাম।" [সূরা আস-সাফফা, আয়াত ১০৬-১০৭]
এই ঘটনার মাধ্যমে কুরবানির বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। যা আজও মুসলিমরা ঈদুল আযহায় পালন করে। এরপর আল্লাহ ইব্রাহিম (আ) তার পুত্র ইসমাইল (আ)-কে কাবা পুনঃনির্মাণের মহান দায়িত্ব দেন। তারা দুইজন নিজ হাতে পবিত্র কাবা পুনরায় নির্মাণ করেন। তারা আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, "হে আমার প্রতিপালক, আমাদের দু'জনকেই মুসলিম করুন, এবং আমাদের বংশধরদের মধ্যেও এমন একটি জাতি করুন যারা মুসলিম হবে। আমাদের (হজের) আনুষ্ঠানিকতা শিখান এবং আমাদের দিকে অনুগ্রহের দৃষ্টি দিন। আপনি সত্যিই তওবা কবুলকারী ও পরম করুণাময়।" [সুরা বাকারা, আয়াত ১২৮]
আজ আমরা যে নিজেদের মুসলিম বলি, তা মূলত ইব্রাহিম (আ) এর এই দোয়ার কারণে। এছাড়াও ইব্রাহিম (আ) মুসলিম উম্মতের জন্য একজন একজন রসূলের দোয়াও করেন। তিনি বলেন, "হে আমার রব, তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসুল পাঠান যে তাদেরকে আপনার বাণী পড়ে শুনাবে, তাদের কিতাব শিক্ষা দিবে এবং তাদের পবিত্র করবে। নিশ্চই আপনিই শর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী।" [সুরা বাকারা, আয়াত ১২৯]
৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) এর জন্ম ছিল ইব্রাহিম (আ) এর এই দোয়ারই ফল। কারণ মহানবী (সা.) ছিলেন, ইসমাইল (আ) এর বংশধর। হযরত ইব্রাহিম (আ) এর জীবন ছিল আত্মত্যাগ, ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি নিখুঁত আনুগত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার পরীক্ষা ও কষ্টগুলো শুধু ব্যক্তিগত নয়। বরং তা সমগ্র মানবজাতির জন্য শিক্ষা হয়ে আছে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, আল্লাহর নির্দেশে কখনো সন্দেহ না করতে। তার প্রতি সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করতে এবং ধৈর্যের সঙ্গে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে। তার ত্যাগের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ তাকে খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু হিসাবে উপাধিতে ভূষিত করেন।
রিফাত