
ছবি : সংগৃহীত
“মক্কা আমার হৃদয়ের গাছ, মদিনা সেই জমিনের ঘাস, আর জেরুজালেম সেই হৃদয়ের মাটি।”- মন্তব্যটি ইউটিউব এর একজন দর্শকের।
তার মতোই দুনিয়ার কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়ে মক্কা, মদিনা আর জেরুজালেম তথা আল আকসা জায়গা নিয়ে আছে। এর কোনটির উপর যখন আঘাত আসে প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে তখন শুরু হয় রক্তক্ষরণ। মক্কা, মদিনা এখন পর্যন্ত নিরাপদ থাকলেও, নিরাপদে নেই মসজিদে আকসা। যেই মসজিদের সাথে জড়িয়ে আছে শত শত নবী রাসূলের ইতিহাস, যে মসজিদের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম, অথচ সেই মসজিদ নিয়ে দ্বন্দ যুগ যুগ ধরে।
এমনকি ইসরাইলের দখলদার বাহিনীর বাধার কারণে সম্প্রতি টানা পাঁচ সপ্তাহ আল আকসায় জুমার নামাজ আদায় করতে পারেনি মুসলমানগণ। তিন ধর্মের এক তীর্থস্থান এই আল আকসা। আর তাদের সবারই পবিত্র ভূমি এই জেরুজালেম। এক ধর্মের ভেতরেই যেখানে থাকে নানা দল ও গোষ্ঠী, স্বার্থের প্রশ্নে যেখানে হরহামেশাই লেগে যায় দ্বন্দ ও সংঘাত, সেখানে তিন ধর্মের এক তীর্থস্থান। বিপত্তি তো ঘটবেই। তবে ঠিক কি নিয়ে বিপত্তি আর দ্বন্দ! তার আগে আসুন জেনে নেই, মসজিদুল আকসার কিছু দরকারি তথ্য।
সর্বপ্রথম মসজিদুল আকসা কে নির্মাণ করেছেন, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। কেউ বলেন, এই মসজিদের প্রথম নির্মাতা হলেন আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম। কেউ বলেন, হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম প্রথম এই মসজিদের ভিত্তি নির্মাণ করেন। আবার কারো মতে, নূহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবনে ধ্বংস হওয়ার পরে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর পুনর্নির্মাণ করেন। এরপর একে একে হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এবং হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এসে আল আকসা মসজিদের নির্মাণের কাজে ভূমিকা রাখেন। যদিও তারা তা শেষ করে যেতে পারেননি। পরে দাউদ আলাইহিস সালামের এর ছেলে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম জিনদের মাধ্যমে বায়তুল মুকাদ্দাসের সংস্কার কাজ শেষ করেন।
মুসলমানদের কাছে এটা এমন এক পবিত্র ভূমি, যেখানে মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রায় সব নবীর আগমন ঘটেছিল। আজকের ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের সাথে যেসব নবী রাসূলের নাম জড়িয়ে আছে তারা হলেন, ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, লুত, ইয়াকুব, ইউসুফ, দাউদ, সুলাইমান, ইয়াহিয়া এবং ঈসা আলাইহিমুস সালাম।
এই মসজিদুল আকসা থেকেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজে গমন করেছিলেন এবং সেখান থেকে ফিরে এসে এই মসজিদে সকল নবীদের জামা’তে ইমামতি করেছিলেন। এছাড়া মক্কার কাবা ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ আদায়ের পূর্বে মুসলমানগণ এই বায়তুল মুকাদ্দাসকেই কেবলা মেনে নামাজ আদায় করতেন।
মসজিদুল আকসার আরো কয়েকটি নাম রয়েছে। মুসলমানরা বলে আল কুদস, আল আকসা এবং বায়তুল মুকাদ্দাস। আর ইহুদিরা বলে টেম্পল অফ মাউন্ট। বাইতুল মুকাদ্দাস জেরুজালেম নগরে অবস্থিত। জেরুজালেম ফিলিস্তিন প্রদেশের অন্তর্গত। তবে এটি একক কোন স্থাপনা নয়। এটি অনেকগুলো স্থাপনার সমন্বয়ে গঠিত বিশাল চত্তর, যাকে বলা হয় হারাম আল শরীফ।
৩৫ একরের এই চত্তরে রয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। আল আকসা মসজিদ বা কিবলি মসজিদ, কুব্বাতু সাকরা বা ডোম অফ দ্যা রক, বোরাক মসজিদ, ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড, মূল আকসা বা কিবলি মসজিদ হলো ধূষর শিষার প্লেট দিয়ে আচ্ছাদিত গম্বুজওয়ালা স্থাপনাটি। অথচ মুসলমানদের অনেকে এই ডোম অফ দা রককেই কেবল মসজিদুল আকসা ভেবে ভুল করে থাকেন। ডোম অফ দা রকের নিচে যে বড় পাথরটি রয়েছে মুসলমানদের বিশ্বাস, এই পাথরের উপর থেকেই বিশ্বনবী মেরাজে গিয়েছিলেন। আর ইহুদিদের বিশ্বাস, এই পাথরের উপরেই তাদের পয়গম্বর আব্রাহাম তার পুত্র ইসমাইলকে উৎসর্গ করার জন্য নিয়ে এসেছিলেন এবং সেখান থেকেই পৃথিবী বিস্তৃতি লাভ করেছে। অন্যদিকে খ্রিস্টানদের ধারণা, তাদের যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করার পর এখানেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
তিন ধর্মের তিন মত। মত থেকে ভিন্ন পথ। আর সেই থেকে দ্বন্দের সূত্রপাত। দ্বন্দের শুরুটা হয় ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের মাধ্যমে। মাত্র ছয় দিনের এই যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হলে পশ্চিম তীর ও জর্ডান নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জেরুজালেম, যেখানে আল আকসা অবস্থিত, দখল করে নেয় ইসরাইল। গত ৫০ বছর ধরে ইসরাইল এসব দখলকৃত জায়গায় ইহুদি বসতি স্থাপন করে আসছে। ৬ লাখের বেশি ইহুদির বসবাস এখন মসজিদুল আকসা ও এর আশেপাশের এলাকায়, ভাবা যায়।
ইসরাইল জেরুজালেম দখলে নিলেও আল আকসায় প্রবেশ করে উপাসনার অনুমতি নেই ইহুদিদের। কারণ বায়তুল মুকাদ্দাস চত্তরটি পরিচালনা করছে জর্ডান ফিলিস্তিনের একটি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান। এজন্য ইহুদিরা সেখানকার ওয়েস্টার্ন ওয়াল ধরে উপাসনা করে। সেই সাথে বিলাপ আর কান্নাকাটি করে প্রার্থনার চিরকুট রেখে যায়। তাদের বিশ্বাস প্রথম ও দ্বিতীয় টেম্পলের চারপাশে দেয়া প্রাচীরের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন এই দেয়ালের উপর ঈশ্বর সর্বদা অবস্থান করেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, মুসলমানের বেশ ধারণ করে প্রায়ই ইহুদিরা আল আকসায় প্রবেশ করে। এই প্রেক্ষাপটে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের বিকৃত রূপ তালমুদে বিশ্বাসী ইহুদিদের প্রভাবশালী মহলের আলোচনায় মাসিহা, থার্ড টেম্পল, লাল গরু শব্দগুলোঘুরে ফিরে আসছে।
ইহুদিরা বিশ্বাস করে, তাদের মুক্তি দিতে এবং সারা বিশ্বে ইহুদিদের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করতে, তাদের মধ্যে একজন মাসিহা বা ত্রাতা আসবেন। কিন্তু যতক্ষণ না কয়েক হাজার বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিং সোলোমনের টেম্পল বা সোলাইমানী মন্দির পুনরায় তৈরি করা হচ্ছে, ততক্ষণ সেই ত্রাতা আবির্ভূত হবেন না। আর তাই টেম্পল ইনস্টিটিউট রিটার্নিং টু দ্যা মাউন্ট এবং বনে ইসরাইলের মত কট্টর ইহুদিবাদী সংগঠনগুলো, মাসিহের আগমনের শর্ত পূরণ করতে বহু বছর ধরে আল আকসা মসজিদ ভেঙে সেই জায়গায় থার্ড টেম্পল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
এমনকি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এরই মধ্যে তারা পুরোহিতের পোশাক, তামার জলপাত্র এবং ২৪ ক্যারেট সোনা দিয়ে বানানো ৪৫ কেজি ওজনের আলোকদানিসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র বানিয়ে রেখেছে। তবে সেই টেম্পল বানাতে হলে আগে তাদের পবিত্র হতে হবে। এর জন্য দরকার তিন বছর বয়সের বিশেষ এক লাল গরু। যার খোঁজে তারা সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছে। কাঙ্খিত গরুটি পেলে তাকে বলি দিয়ে পুড়িয়ে সেই ছাই আর রক্ত গায়ে মাখতে পারলে তবেই হবে ইহুদি জাতি পুত পবিত্র। এরপর বানাবে থার্ড টেম্পল। এরপর আসবে তাদের ত্রাতা দাজ্জাল।
অন্যদিকে ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, ইহুদিদের এই ত্রাণকর্তাই হচ্ছে দাজ্জাল, যে এক নিমিষে অসুস্থকে সুস্থ করা, আর মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করার মত নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে। শাম দেশ থেকে বের হয়ে গোটা বিশ্বে রাজত্ব কায়েম করবে। প্রাচীন শাম বলতে বর্তমান সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও ফিলিস্তিনকে বোঝায়।
দাজ্জাল আগমনের ৪০ দিন কিংবা মাস অথবা ৪০ বছর পর ইহুদি বাহিনীর সাথে মুসলমানদের এক বিরাট ধর্মযুদ্ধ শুরু হবে। তবে যুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে দেখে দাজ্জাল লবণের মত গলতে শুরু করবে। বর্তমান ইসরাইলের বাবে লুত নামক স্থানে ঈসা আলাইহিস সালাম দাজ্জালকে বর্ষা দিয়ে হত্যা করবেন বলে হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। কেয়ামতের ঠিক আগ মুহূর্তের সেই যুদ্ধে, চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে মুসলমানগণ।
হাদিসে এসেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেয়ামত হবে না, যতক্ষণ না মুসলমানেরা ইহুদিদের সাথে যুদ্ধ করবে। অতঃপর মুসলমানগণ ইহুদিদেরকে হত্যা করবে। ইহুদিরা গাছ ও পাথরের আড়ালে পালাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু কেউ তাদেরকে আশ্রয় দিবে না। গাছ বা পাথর বলবে, হে মুসলমান, হে আল্লাহর বান্দা, আমার পেছনে একজন ইহুদি লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা করো। তবে গারকাত নামক গাছের পেছনে লুকালে, গারকাত গাছ কোন কথা বলবে না। এটি ইহুদিদের গাছ বলে পরিচিত।
মো. মহিউদ্দিন