পৃথিবীর নিকৃষ্ট শাসক নমরুদ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে হত্যা করার জন্য কিভাবে শকুনের উড়ন্ত যান তৈরি করেছিল এবং কিভাবে শকুনের জান দিয়ে আসমানে উড়ে গিয়েছিল, আবার কিভাবে জীবিত অবস্থায় আসমান থেকে জমিনে ফিরে এসেছিল? কেন আল্লাহ তায়ালা নমরুদকে আকাশের উপরে ধ্বংস করে দেননি এবং কি জন্য নমরুদকে একের পর এক সুযোগ দেয়া হয়েছিল?
নমরুদ এবং ফেরাউনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ছিল। ফেরাউন জানতো আল্লাহই হচ্ছেন পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা। কিন্তু জেনে শুনে সে এটা গোপন করত। কিন্তু নমরুদ ছিল মাথামোটা। নমরুদ এবং ফেরাউন দুজনেই নিজেকে খোদা দাবি করেছিল। কিন্তু নমরুদ কখনো জানত না যে তার উপরে আরেকজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছে।
আর এজন্যই আল্লাহ রব্বুল আলামিন ফেরাউনের থেকেও নমরুদ কে বেশি সুযোগ দিয়েছেন নিজের ভুল বোঝার জন্য। ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে যখন অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হলো এবং সেখান থেকে অক্ষত অবস্থায় তিনি জীবিত বের হয়ে আসলেন, তার পর থেকেই নমরুদ ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের কাছ থেকে বারবার তার সৃষ্টিকর্তার সম্পর্কে জানতে চাইতেন।
নমরুদ প্রকাশ্যে বলেছিল, আমি তোমার স্রষ্টার সাথে যুদ্ধ করে তোমাকে বুঝিয়ে দেব যে আমিই সবচেয়ে বড়। জবাবে ইব্রাহিম (আঃ) বার বার এক এবং অদ্বিতীয় খোদার দাওয়াত দিতেন। আমি অন্য খোদার বশ্যতা স্বীকার করতে পারি না। তবে আমি শীঘ্রই তোমার খোদার প্রাণ শেষ করে তার রাজ্য কেড়ে নিব। নাউযুবিল্লাহ!
ইব্রাহিম (আঃ) বললেন, হে কাফের নমরুদ! তুমি আমার আল্লাহর নিকট যাবে কেমন করে? নমরুদ জবাব দিল, সে জন্য তোমার চিন্তা করতে হবে না।
এরপর পাপিষ্ঠ নমরুদ পাপাত্মা ইবলিসের পরামর্শ অনুযায়ী চারটি শকুন পাখি লালন পালন করে এগুলোকে হৃষ্টপুষ্ট করল এবং ইবলিসের সহযোগিতায় এই শকুন পাখিগুলো নমরুদের কথামত তার ইশারায় তার কাছে এসে উপস্থিত হতো। তারপর নমরুদ চারটি মোটাতাজা মানুষকে জবাই করল। তার চামড়া খুলে ফেলে। তার মাংস শকুনের মাথার উপরে এমনভাবে ঝুলিয়ে দিল যে, শকুন গুলো সেই চামড়া থেকে মাংস খুঁটে খাওয়ার জন্য উপরের দিকে যখন মুখ ওটাতো তখনই নমরুদের সৃষ্টি করা স্বয়ংক্রিয় যানটি আকাশের দিকে উড়তে থাকত।
এখানে এই মেকানিজমে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করেছিল ইবলিস। আল্লাহ পাক ও চাইছিলেন নমরুদ যেন তার মনের আশা পূর্ণ করতে পারে। কেননা নমরুদ ইবরাহীম (আঃ) সাথে শপথ করেছিল যে, কোন মূল্যেই সে আকাশে উঠবে এবং ইব্রাহিমের খোদাকে ধ্বংস করে দিয়ে তার পরে সে ইব্রাহিমের কাছে আসবে। তারপর নমরুদ যথারীতি তীর ধনুক নিয়ে একটি স্বয়ংক্রিয় গান তৈরি করল, যার চারটি কোণা রইল। চার কোণায় চারটি শক্তিশালী শকুনকে বেঁধে দেয়া হল। ইবলিস শকুন গুলোর উপর ভর করল।
অতঃপর শকুন গুলো নমরুদের ঝোলানো মেষের চামড়ার দিকে মুখ উঠানো মাত্রই যানটি আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে থাকলো। কেননা শকুন গুলো সেই মাংস খাওয়ার জন্য উড়ছিল। এভাবে শকুন চারটা মাংস দেখে তা ধরার জন্য ক্রমে ঊর্ধ্বমুখে উঠতে লাগলো। সেই সাথে নমরুদের সেই স্বয়ংক্রিয় যানটি ও উপরে উড়তে লাগল। নিজের জন্য কয়েক দিনের উপযোগী খাদ্য ও পানীয় সঙ্গে নিয়েছিল। এভাবে একাধারে তিন দিন তিন রাত ক্রমাগত উপরে আরোহণ করার পর সে মনে করল যে, এখন আসমানের খোদার একেবারে নিকটে চলে এসেছে। নাউযুবিল্লাহ!
এরপর নমরুদ সেখান হতে উপরের দিকে কতগুলো তীর নিক্ষেপ করল। আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা জিবরাইল আলাইহিস সালামকে বললেন, হে জিব্রাইল! আমি আমার পরম শত্রুকেও নিরাশ করি না। তুমি নমরুদের মনের আশা পূর্ণ করে দাও। তার নিক্ষিপ্ত তীরের প্রত্যেকটির মাথায় এক একটি মাছের রক্ত মেখে দাও, যাতে নমরুদের এ ধারণা হয় যে, সে আসমানের খোদাকে নিহত করেছে। ফেরেশতা জিবরাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর আদেশ অনুসারে নমরুদের তীরের মধ্যে রক্ত মাখিয়ে আবার এমনভাবে নিচে প্রেরণ করল, যাতে নমরুদের স্বয়ংক্রিয় যানের উপরে অধিকাংশ তীর এসে পড়ল। ঐ রক্তমাখা তীরগুলি নমরুদের শক্তি চালিত রথের উপর পতিত হল।
যা দেখে নমরুদ খুবই খুশি হল এবং সে ধরেই নিল ইব্রাহিমের খোদাকে সে নিহত করতে পেরেছে এবং অত্যন্ত আনন্দ নিয়ে সে এবার নিচে নেমে আসার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু ভাবনায় পড়ে গেল যে সে নিচে নামবে কী করে? পাপিষ্ঠ ইবলীস তার আবার সার্বক্ষণিক বন্ধুর মত তাকে পরামর্শ দিয়ে বলল, তুমি মেষের মাংস বিশিষ্ট চামড়া গুলোকে এবার শকুনের নিচের দিকে নামিয়ে নিয়ে আস। এমনভাবে নামাও যেন শকুন গুলো ধরতে না পারে। এভাবে শকুন গুলোর মাথা নিচের দিকে নেমে গেলে তোমার যানটি নিচের দিকে নেমে যাবে।
এভাবে আবার একাধারে তিন দিন তিন রাত নামার পর নমরুদ জমিনে এসে পৌঁছাল। তখন গৌরবের অহমিকায় অস্থির হয়ে পড়ল। মাটিতে নেমে প্রথমেই সে গেল হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর কাছে। তাকে রক্তমাখা তীরগুলি দেখিয়ে সগৌরবে বলতে লাগল, দেখলেতো ইব্রাহিম, তোমার খোদার বড়াই আমি শেষ করে দিলাম। আমার নিক্ষিপ্ত তীর তোমার খোদাকে বিদ্ধ করে দিয়েছে। নাউজুবিল্লাহ। প্রত্যেকটি তীরেই রক্তমাখা রয়েছে। হযরত ইব্রাহীম বললেন, ওহে নির্বোধ কাফের!আমার আল্লাহ তায়ালাকে হত্যা করতে পারে এমন শক্তি কারো নেই। তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী। তার কোন মৃত্যু নেই। তিনি অদৃশ্যমান, নিরাকার। তাকে মানুষের আকারে কল্পনা করাটাও তো বোকামি। তার উপরে কারো কোন শক্তি ক্ষমতা সক্রিয় হতে পারে না। মহান প্রভু তোমার উপরে এখনও দয়াশীল আছেন বলেই তোমার দীর্ঘ তিন দিনের কষ্ট সাধনার একটা ফল তিনি তোমাকে পাঠিয়েছেন। এখনো সময় আছে তার উপর ঈমান আনো। কথাগুলো শুনে নমরুদ প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে বলল, বল, তোমার খোদার সৈন্য সংখ্যা কত? আমি এক্ষুণি তোমার খোদাকে শেষ করে দিচ্ছি।
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম বললেন, আমার খোদার সৈন্যসামন্ত এর সংখ্যা আমি নিজেও জানি না। তা অসংখ্য। কেউ এর সংখ্যার হিসাব দিতে পারবে না। তিনি নিজেই শুধুমাত্র এর সঠিক সংখ্যা জানেন। নমরুদ বলল, আচ্ছা সমস্যা নেই। তোমার খোদার সৈন্য সংখ্যা জানার আমার তেমন কোন প্রয়োজন নেই। তবে তুমি তোমার খোদাকে আমার সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হতে বলো। আর যদি তাদের আমার সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহস থাকে তবে সামনে আসতে বলো। যদি সামনে না আসে আমি ভেবে নেব তারা ভীত, কাপুরুষ।
হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম বললেন, ওহে নির্বোধ! আমার খোদার সেনার সাথে যুদ্ধ করতে যদি তোমার এতই আগ্রহ থাকে তবে বেশ তাই করো। তুমি তোমার সকল সৈন্যকে প্রস্তুত হতে বলো। নমরূদ তার অসংখ্য সৈন্যবাহিনীকে খোদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আদেশ দান করলেন। তার সৈন্য বাহিনীর মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। তাছাড়া নমরুদ সারা দুনিয়ায় তার যত অধীন এবং অনুগত রাজা বাদশাহ ছিল, তাদের সকলের প্রতিও কড়া আদেশ দিল যে, অবিলম্বে তারা যেন নিজেদের সৈন্য সামন্ত সহ বাবিলের দিকে রওয়ানা হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীর ইতিহাসে তিনজন বাদশাহ পুরো পৃথিবীকে শাসন করেছেন। এদের একজন সুলাইমান আলাইহিস সালামদ্বিতীয়জন জুলকারনাইন এবং তৃতীয়জন বুধ। নমরুদের নির্দেশে পুরো বিশ্বের সকল সৈন্যবাহিনী এক প্রবল আসমানি সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। আর এই আদেশ পেয়ে বাহিনীতে যত সামন্ত আছে সব নিয়ে রাজা বাদশাহগণ বাহুবলে এসে একত্রিত হল। হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম নমরুদের কীর্তিকলাপ দেখে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, হে মাবুদ! আপনি সকল কিছুই দেখছেন। বাদশাহ নমরুদ যেভাবে স্পর্ধার সীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং অহংকারে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে, তার দর্প শেষ না করলে দুনিয়ার সাধারণ জনগণও তা দেখে ব্যাপক আকারে বিভ্রান্ত হবে এবং বিপথে চলে যাবে।
ইতিমধ্যে আপনার পাঠানো রক্তরঞ্জিত তীরগুলি দেখিয়ে সে অসংখ্য মানুষকে পথভ্রষ্ট করছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের দোয়া মঞ্জুর করলেন। ফেরেশতা জিবরাইল আলাইহিস সালাম এসে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার চিন্তার কোন কারণ নেই। অতি শীঘ্রই আল্লাহ তায়ালা পাপিষ্ঠ নমরুদকে চরম শাস্তি প্রদান করবেন। নমরুদ ও তার বেইমান সৈন্যসামন্ত সকলেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কথিত আছে যে, বাবিলে বিভিন্ন রাজ্য হতে এতো অধিক পরিমাণে সৈন্য এসে একত্রিত হলো যে, তাদের তাঁবুর বহর প্রায় পঞ্চাশ মাইল এলাকা ব্যাপী বিস্তৃত হলো।
নমরুদের এমন সৈন্যসামন্ত একত্রিত হওয়া এবং প্রস্তুত হওয়ার পরেও ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাকে গিয়ে বললেন, হে নমরুদ তুমি কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাচ্ছ? চিন্তা ভাবনা করে দেখেছ কি? যার নিকট তুমি ও আমি সকলেই মুখাপেক্ষী। যিনি আমাদের সকলের রুজির ব্যবস্থা করেন, যার ক্ষমতা এত অসীম ও প্রবল যে, ইচ্ছে করলে তিনি চোখের পলকে সারা পৃথিবী শেষ করে দিতে পারেন। তার বিরুদ্ধে এমন জাকজমকের সাথে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নির্বুদ্ধিতা। এখনো সময় আছে নমরুদ তোমার প্রভু তোমার উপর এখনও দয়াবান। দেখতে পাচ্ছ, এখনো আসমান থেকে কোনো আযাব নাযিল হয়নি। কেননা তুমি অজ্ঞ এবং মূর্খ।
তাই তোমার প্রভু এখনো তোমার প্রতি ধৈর্যশীল আছেন। তুমি এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। এ কথা শুনে পাপিষ্ঠ নমরুদ বলল, হে ইব্রাহিম! তুমি আমার এ সামান্য প্রস্তুতিতেই ভয় পেয়ে গেছ বুঝি? তোমাকে আমি এর আগেও বলেছি। আবারও বলছি, তুমি আমাকে এখনো তোমার খোদার শক্তির মিথ্যা ভীতি প্রদর্শন করা বন্ধ কর। আমি তোমার এসব কথায় ভয় পাওয়ার মত লোক নই। তোমার খোদার সৈন্য সংখ্যার নাকি কোন শেষ নেই। আমি দেখতে চাই এই সকল সৈন্যের শেষ কোথায়। আর বার বার আমার কাছে এসব দাওয়াত নিয়ে এসো না। ঐ কথা শুনলে আমার বিরক্তি লাগে।
নমরুদের কথা শুনে আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর মনে বড় কষ্ট এবং ব্যথা লাগল। তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন, হে মাবুদ!
আমি নমরুদকে তোমার পথে আনার ভুল চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমি যতই চেষ্টা করি ততই আমাকে দুর্বল ভেবে সে নিজেকে অজেয় শক্তির অধিকারী বলে মনে করে। অতএব এখন আর তার শাস্তির বিধান না করে পারা যায় না।
(১ম পর্ব)
ফুয়াদ