ছবি : সংগৃহীত
একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস, যিনি হয়েছিলেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন। শুধু তাই না, বেঁচে থাকতেই তিনি জান্নাতের সুসংবাদ পান। কিন্তু তার শুরুর জীবনটা মোটেও এত সহজ ছিল না। একজন রাজকন্যার সন্তান হয়েও মক্কায় ছিলেন ক্রীতদাস হিসেবে। এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখার জন্য তাকে সহ্য করতে হয়েছে অকথ্য নির্যাতন। তারপরও তিনি ছিলেন সম্মানিত।
বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর জন্ম ৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায়। তার মা ছিলেন আবিসিনিয়ার এক রাজকন্যা। কিন্তু সেই রাজকন্যাকে জোরপূর্বক বন্দি করে মক্কায় দাস হিসেবে নিয়ে আসা হয়। বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু একটু বড় হলে তাকে দাস হিসেবে নিয়ে যায় মক্কার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি উমাইয়া ইবনে খালাব। সেখানেই ক্রীতদাস হিসেবে বড় হতে থাকেন বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।
এদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন, তখন মক্কার প্রভাবশালীরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ঠিক এমনই একটি ষড়যন্ত্রের বৈঠক হচ্ছিল উমাইয়া ইবনে খালাফের বাসায়। তাদের সব ষড়যন্ত্র শুনে ফেলেন বিলাল। তার মনে আগ্রহ জাগলো একবার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখার। তিনি লুকিয়ে চলে এলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে আর তার কথা শুনে নির্দিধায় বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ইসলাম কবুল করলেন।
যখন বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর ইসলাম কবুলের বিষয়টি তার মনিব জানতে পারলো, তখন তার উপর নেমে এলো কঠিন এক সময়। তার খাবার, পানি সব বন্ধ করে দেয়া হলো। মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে তাকে বেঁধে রেখে দেয়া হলো চাবুকের ঘা। তার উপর রেখে দেয়া হলো বিশাল এক পাথর। ইবনে খালাফ তার উপর নির্যাতন চালালো আর জিজ্ঞেস করল, বলো, কে তোমার খোদা? তুমি কার দাস?
বিলাল বললেন আহাদ, আহাদ যার অর্থ এক আল্লাহ, এক আল্লাহ। প্রচন্ড অত্যাচারের পরেও বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এক আল্লাহর উপর ঈমান রাখলেন। কোন কিছুই যেন তার ঈমানকে দুর্বল করতে পারলো না। তার এমন করুণ অবস্থার কথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর সিদ্দিকী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে পাঠালেন বিলালকে মুক্ত করতে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ইবনে খালাফের কাছে জানতে চাইলেন, সে কত টাকার বিনিময়ে বিলালকে মুক্ত করবে?
ইবনে খালাফ দশটি স্বর্ণমুদ্রা দাবি করল। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু দশটি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বিলালকে মুক্ত করলেন। মুদ্রা হাতে পেয়ে ইবনে খালাফ হেসে বলল, আবু বকর, তুমি যদি আমার সাথে দামাদামি করতে তাহলে আমি এক মুদ্রার বিনিময়েও বিলালকে ছেড়ে দিতাম।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন, আর তুমি যদি আমার কাছে ১০০ মুদ্রাও দাবি করতে আমি তা দিয়ে বিলালকে মুক্ত করতাম। মুক্ত হলেন বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু। মুক্তির পর থেকে তিনি হয়ে উঠলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ঠ সহচর। যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো সময়ে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাশে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকেন।
সহি বুখারীর একটি হাদিস অনুযায়ী, ‘একদিন ফজরের নামাজের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন, বিলাল ইসলাম কবুলের পর তুমি কি এমন ভালো কাজ করেছো, যে জান্নাতে আমি আমার সামনে তোমার পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছি’ অর্থাৎ বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু জীবিত থাকা অবস্থা জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন।
যখন মদিনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ নির্মাণ করলেন আর মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকলো, তখন সবাই কথা বলা শুরু করলেন, কিভাবে মানুষকে নামাজের সময় ডাকা হবে। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু স্বপ্নে দেখলেন, একজন লোক তাকে আযানের কথাগুলো শিখাচ্ছে। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এটি বলার পর, তিনি বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে ডেকেই ইবনে জায়েদের শেখানো কথাগুলো দিয়ে আযান দিতে বললেন। সেই থেকে বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হলেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যতদিন বেঁচে ছিলেন, বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ততদিন নিয়মিত আযান দিয়েছিলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিদায়ের পর তিনি মাত্র দুইবার আজান দিতে পেরেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিদায়ের ঠিক পরের ওয়াক্তের আজান যখন তিনি দিচ্ছিলেন, তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে আযান শেষ করেন আর তার জীবনের শেষ আজান তিনি দেন সিরিয়াতে।
ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যখন খলিফা হিসেবে সিরিয়ায় যান, তখন তার অনুরোধে তিনি তার জীবনের শেষ আজানটি দেন। বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর কোন সম্পদ ছিল না এবং তার কোন উত্তরাধিকারীও ছিল না। কিন্তু মহান আল্লাহর কাছে তিনি এতটাই প্রিয় যে, কোন কোন বর্ণনায় আসে, বিলাল রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর পর থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মুয়াজ্জিন আছেন, সবাই তার উত্তরাধিকারী আর আজান হচ্ছে তাদের উত্তরাধিকারী সম্পদ।
মো. মহিউদ্দিন