ইতিহাসের এক অসাধারণ অধ্যায় হলো মুতার যুদ্ধ। এটি ছিল এমন একটি যুদ্ধ যেখানে সংখ্যায় অতি নগণ্য একদল সাহাবী রোমান সাম্রাজ্যের বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে সাহসিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় অষ্টম হিজরীতে, বর্তমান জর্দানের মুতায়। মুসলিম বাহিনীর মাত্র ৩,০০০ সৈন্যের মুখোমুখি হয়েছিল ১ লক্ষ রোমান যোদ্ধা, যাদেরকে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শক্তি বলে গণ্য করা হতো। শুধু রোমান বাহিনী নয়, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল আরও ১ লক্ষ আরব খ্রিস্টান।
এই অসম শক্তির বিরুদ্ধে মুসলিম সাহাবীগণ শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং ইতিহাসে এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
মুতার যুদ্ধের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এটি সেই একমাত্র যুদ্ধ যেখানে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক মনোনীত তিনজন সামরিক কমান্ডার—জায়েদ বিন হারিসা (রাদিয়াল্লাহু আনহু), জাফর বিন আবু তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু), এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাদিয়াল্লাহু আনহু)— প্রত্যেকে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
যুদ্ধের এই সংকটময় মুহূর্তে সেনাপতিত্ব গ্রহণ করেন খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু), যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে তার অসাধারণ সামরিক কৌশল প্রদর্শন করে মুসলিম বাহিনীকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। তার অসাধারণ বীরত্বে বিশাল রোমান বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং তাদের অগ্রাভাগ সম্পূর্ণ ভেঙে যায়।
খালিদ বিন ওয়ালিদের এই বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে “সাইফুল্লাহ” বা আল্লাহর তরবারি উপাধি প্রদান করেন।
মুতার যুদ্ধ ছিল রাসূলুল্লাহর জীবদ্দশায় রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত একমাত্র যুদ্ধ। এটি শুধু মুসলিম উম্মাহর জন্য নয়, গোটা মানব ইতিহাসেই এক অনন্য অধ্যায়।
অষ্টম হিজরী মোতাবেক ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের কয়েক মাস পূর্বে ঘটে এক ঐতিহাসিক ঘটনা, যা ইসলামের ইতিহাসে “মুতার যুদ্ধ” নামে পরিচিত। বদর, খন্দক ও খাইবারের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ধারাবাহিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে আরবে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মদিনার ইসলাম। এই সময় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকার শাসকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত প্রেরণ করতে থাকেন।
এর অংশ হিসেবে হারিস ইবনে ওমাইর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে একটি চিঠি সহ বসরার গভর্নরের কাছে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু তৎকালীন বসরার গভর্নর, গাসান গোত্রের নেতা সুরাখ বিল ইবনে আমর, তাঁকে আটক করে হত্যা করেন। এই ঘটনা মুসলিম সমাজে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি করে। প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ৩০০০ সদস্যের সেনাবাহিনী গঠন করেন, যা তখন পর্যন্ত মদিনার মুসলিমদের বৃহত্তম সামরিক সমাবেশ ছিল।
কমান্ডারদের নিয়োগ
প্রথম কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জায়েদ বিন হারিসা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে। দ্বিতীয় কমান্ডার ছিলেন জাফর বিন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এবং তৃতীয় ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দেন, "যদি প্রত্যেক কমান্ডার শাহাদাত বরণ করেন, তবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরবর্তী কমান্ডার নির্ধারণ করবে।"
যুদ্ধের শুরু
মুসলিম বাহিনী জর্দানের সীমান্তে পৌঁছায়। শত্রুপক্ষের শক্তি ছিল বিপুল—প্রায় দুই লক্ষ সৈন্য, যার মধ্যে এক লক্ষ রোমান সেনা এবং এক লক্ষ আরব খ্রিস্টান। মাত্র ৩০০০ মুসলিম যোদ্ধার পক্ষে এই বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা ছিল এক অসম লড়াই।
যুদ্ধক্ষেত্রের বীরত্ব
যুদ্ধে প্রথম কমান্ডার জায়েদ বিন হারিসা শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন জাফর বিন আবু তালিব, যিনি শত্রুর প্রবল আক্রমণের মধ্যেও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হন। এরপর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, যিনি ঈমানী শক্তি দিয়ে সৈন্যদের উজ্জীবিত করেন। তিনিও শাহাদাত বরণ করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে।
খালিদ বিন ওয়ালিদের বীরত্ব
এই সংকট মুহূর্তে সৈন্যদের নেতৃত্ব দেন নবাগত মুসলিম খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু। অসাধারণ রণকৌশল ও ব্যক্তিগত বীরত্বের মাধ্যমে তিনি মুসলিম বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর হাতে একে একে ভেঙে যায় নয়টি তলোয়ার, যা তাঁর প্রবল আক্রমণের সাক্ষ্য বহন করে।
যুদ্ধের ফলাফল
মুসলিম বাহিনী শত্রুর বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই করে। যদিও এটি একটি অমীমাংশিত যুদ্ধ ছিল, তবে এতে মুসলিমদের বীরত্ব আরবের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে।
সুদূরপ্রসারী প্রভাব
মুতার যুদ্ধ মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং রোমান সাম্রাজ্যের মতো পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণা দেয়। এই যুদ্ধের পর, ইসলামের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বহু গোত্র ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
এই ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ঈমান ও সাহসিকতার শক্তি দিয়ে যেকোনো অসম যুদ্ধেও বিজয়ের আশা করা যায়।
রাজু