
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতের ন্যায় নির্বাচনের আগে আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। শেখ হাসিনা সরকারের নির্দেশে নির্বাচন কমিশনে বাতিল হওয়া দলটির নিবন্ধন এবং প্রতীক নিয়ে এখনো আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত। ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার নিবন্ধন এবং প্রতীক ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার কথা রয়েছে আদালতে। এরই মাঝে নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে প্রাথমিক প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে দলটি।
ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার প্রস্তুতি রয়েছে জামায়াতের। ঐকমত্য হলে নির্বাচনে একটি ব্যালট বাক্স (একক প্রার্থী) রাখার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে জামায়াত। দিনক্ষণ এখন পর্যন্ত ঠিক না হলেও জামায়াত আগামী রমজান অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ করার দাবি করেছে। অবশ্য তার আগে প্রয়োজনীয় দৃশ্যমান সংস্কার এবং জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যার বিচার দেখতে চেয়েছে দলটি।
পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, প্রতিনিধি ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে জামায়াত। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নে রাজনৈতিক সফর এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদল। যেখানে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের প্রতিশ্রুতির কার্যকারিতা দেখতে চান বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
গত ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। বৈঠকে আগামী রমজানের আগে যাতে নির্বাচন হয়ে যায় সে বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। যেখানে জামায়াত আমির বলেছেন, আমরা সবসময় নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা করি এবং আমাদের দেশেও গণতন্ত্র চর্চা করতে চাই। এজন্য আমাদের যা করণীয় তা আমরা করব। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলেছি, প্রত্যেকটা ক্রেডিবল ইলেকশনে আমরা অংশগ্রহণ করেছি। কম হোক, বেশি হোক সংসদের ভেতরে আমাদের সংসদ সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশে মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল এরশাদ সাহেবের সময়, তখনকার জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব ইলেকশনকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কেয়ারটেকার সরকার ফর্মুলা প্রস্তাবনার মাধ্যমে।
যেটা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দলীয় স্বার্থে এটাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এখন আবার সারা জাতি এটা চাচ্ছে এবং আমরা আশা করি এটা আবার সংবিধানে সন্নিবেশিত হবে।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সফর শেষে গত ১৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলেন জামায়াত আমির। সেখানে নির্বাচনে যাওয়ার আগে তিনটি দাবি তুলে ধরে জামায়াত আমির বলেন, হাজার প্রাণের বিনিময়ে, হাজার হাজার মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে, আহত হওয়ার বিনিময়ে দেশে এই পরিবর্তন এসেছে। তাই অবশ্যই সংস্কার সাধন করতেই হবে। এই সংস্কার কারা করবে? সংস্কারের প্রধান অংশীজন হলো রাজনৈতিক দলগুলো।
রাজনৈতিক দলগুলো যত তাড়াতাড়ি ও আন্তরিকতার সঙ্গে সংস্কারে সহযোগিতা করবে, তত তাড়াতাড়ি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে। সংস্কার যদি না হয়, তাহলে সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির বিষয়ে দেশের মানুষের যে প্রত্যাশা, সেটি পূরণ না হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে পড়বে। আর তার দায় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে বাস্তবতার কাতারে এসে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সংস্কারে সহযোগিতা করতে হবে।
দ্বিতীয় দাবি হলো, যারা নিহত ও আহত হয়েছেন, এই খুনের দায় যাদের, তাদের বিচারের আওতায় এনে দৃশ্যমান বিচার এই জাতিকে দেখাতে হবে। যাতে খুনিদের বিচারের বিষয়ে জাতির আস্থা ফিরে আসে।
তৃতীয় দাবির বিষয়টি জানিয়ে শফিকুর রহমান বলেন, এটি হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পর সম্মান করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। জিতে গেলে নির্বাচন সুষ্ঠু, আর হেরে গেলে দুষ্টÑ এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে সেই নির্বাচনটা এমন হতে হবে, যে নির্বাচন নিয়ে কেউ যেন সহজে প্রশ্ন তুলতে না পারে।
এ জন্য অনেক ডায়ালগ ও এনগেজমেন্টের (আলাপ-আলোচনা-সম্পৃক্ততা) প্রয়োজন। এটি সরকারের তরফ থেকে হতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব উদ্যোগে হতে পারে, সিভিল সোসাইটি (সুশীল সমাজ) থেকেও হতে পারে। এটা যখন মাল্টিপল (বহুপক্ষীয়) জায়গা থেকে হবে, তখন একটা পরিবেশ তৈরি হবে। তারা সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি। তবে তার আগে দৃশ্যমান সংস্কার দেখতে চায় দেশের জনগণ। নির্বাচন নিয়ে বছর মাস কিংবা দিন কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত আমরা নির্দিষ্ট করে দেইনি। আমরা চাই, চব্বিশের আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের দৃশ্যমান বিচার।
নির্বাচন আমরাও দ্রুত চাই। তবে সেটা অবাধ নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সেটার জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। আর এজন্য দরকার ইলেকশন, জুডিসিয়াল, সংবিধান, পুলিশসহ ৬- ৭টি জায়গায় সংস্কার। এটা না করলে নির্বাচন ১৪, ১৮ ও ২৪-এর মতোই হবে।
ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও প্রচার বিভাগীয় সম্পাদক অ্যাড. মতিউর রহমান আকন্দ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলমান। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
জামায়াতের নিবন্ধন ইস্যুতে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী দাঁড়িপাল্লা প্রতীকসহ দলের নিবন্ধন পেয়েছিল। এ কারণে যখন ফের নিবন্ধন ফিরে পাবে তখন দাঁড়িপাল্লা প্রতীকসহই পাবে। এর ব্যত্যয়ের সুযোগ নেই।
দলটির আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, শিগগিরই জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পাবে।