ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলাদেশ কি পাকিস্তান ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির দিকে ঝুঁকছে?

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:২৪, ১৮ এপ্রিল ২০২৫; আপডেট: ১১:১০, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশ কি পাকিস্তান ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির দিকে ঝুঁকছে?

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশ কি পাকিস্তান ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির দিকে ঝুঁকছে—এই প্রশ্নে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, এখন থেকে দেশের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিয়ে প্রো-বাংলাদেশ নীতি অনুসরণ করা হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোনো প্রতিবেশীকে খুশি রাখতে আরেক প্রতিবেশীকে দূরে ঠেলে দেওয়ার নয়—এই বার্তাই পরিষ্কারভাবে দেওয়া হয়েছে।

শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আজাদ মজুমদার নিজস্ব ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে করা এক পোস্টে এসব জানিয়েছেন।

পোস্টটিতে তিনি লিখেছেন, সেদিন এক প্রশ্ন উঠেছিল—বাংলাদেশ কি এখন পাকিস্তান ঘেঁষা বিদেশনীতির দিকে যাচ্ছে? এই প্রশ্নে আমাদের মোটেও বিস্ময় হয়নি। সবসময়ই কিছু মানুষ থাকবে যারা কখনোই বাংলাদেশের স্বাধীন পরিচয়ে বিশ্বাস রাখতে পারবে না। আমাদের জবাব ছিল সোজাসাপ্টা—বাংলাদেশের বিদেশনীতি অতীতে যাই হয়ে থাকুক না কেন, এখন থেকে তা হবে পুরোপুরি প্রো-বাংলাদেশ, দেশের স্বার্থকেই মুখ্য করে। 

সম্প্রতি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে আজাদ মজুমদার বলেছেন, ‘নিজেদের সব কথাকে কাজে রূপ দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সময় নিয়েছে মাত্র ২৪ ঘণ্টারও কম। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালোচের সফরের সময় বাংলাদেশ তাকে দুই দেশের মধ্যকার বহুদিনের ঝুলে থাকা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মনে করিয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি পারস্পরিক স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহও দেখিয়েছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের অন্যতম বাধা হচ্ছে—১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের জন্য বাংলাদেশ যে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি করেছে, তা। পাকিস্তানের বেসামরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই মনে করেন, একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা হলে তা হবে সদিচ্ছার ও মহানুভবতার পরিচয়। কিন্তু পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর ও সামরিক আমলাতন্ত্র সবসময়ই এই ধারণার বিরোধিতা করে এসেছে, ফলে এখনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা হয়নি।’

 বাংলাদেশ আরও একটি বিষয় জোরালোভাবে তুলে ধরেছে—সম্পদের ভাগাভাগি। এটি অতীতের সরকারগুলো প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, যারা আলোচনার চেয়ে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রাখাকেই শ্রেয় মনে করত। এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৯৭৪ সালের হিসেবে বাংলাদেশের পাওনার পরিমাণ অন্তত ৪.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই হিসাবটি করা হয়েছিল অভ্যন্তরীণ মূলধন গঠন, বৈদেশিক ঋণের নিষ্পত্তি এবং বৈদেশিক আর্থিক সম্পদের উপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশের আরও একটি অতিরিক্ত দাবি রয়েছে—প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার, যা ১৯৭০ সালের নভেম্বরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিদেশি দেশ ও সংস্থাগুলোর অনুদান হিসেবে এসেছিল। টাকাগুলো ঢাকাস্থ স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের দপ্তরে ছিল, যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানান্তর করে লাহোর শাখায় পাঠানো হয়।’ বলেছেন প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আজাদ মজুমদার।

তিনি আরও জানিয়েছেন, আরও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে পাকিস্তানে আটকে থাকা নাগরিকদের প্রত্যাবাসন। অতীতে পাকিস্তান প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষকে ফেরত নিয়েছে, কিন্তু এখনো প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার মানুষ বাংলাদেশের ১৪টি জেলার ৭৯টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে আছেন।

এসব বিষয়ই দুই দেশের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর ও ভবিষ্যৎ-ভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে বাধা হয়ে আছে।

এবং এসব সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো—আলোচনা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঠিক সেটাই করছে। দীর্ঘ সময় পর তারা পাকিস্তানকে আলোচনার টেবিলে এনেছে এবং পুরোনো সমস্যাগুলো উত্থাপন করেছে, পাশাপাশি পারস্পরিক লাভজনক বাণিজ্য সম্ভাবনাও অনুসন্ধান করছে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, চলতি বছরের শুরুতে মিশরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠকের সময়ও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। আর বৃহস্পতিবার স্টেট গেস্ট হাউস যমুনায় বালোচের সঙ্গে বৈঠকে একই বিষয় পুনরায় উল্লেখ করেছেন। তবে একই বৈঠকে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন—পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একটি সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যাতে এই অঞ্চলের বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়।

পূর্বে যুদ্ধবিগ্রহে জড়ানো দেশগুলোর পরে একে অপরের মিত্র হওয়ার বহু উদাহরণ রয়েছে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যুদ্ধ করেছিল, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একত্রে লড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে বোমা ফেলেছিল, পরে তারাই আবার জাপানকে মিত্রে পরিণত করে।

তাই এখন সময় এসেছে—বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অতীতের সমস্যাগুলো সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়ার, ভবিষ্যতের সম্ভাবনার জন্য। এক প্রতিবেশীকে খুশি করতে গিয়ে অন্য প্রতিবেশী থেকে দূরে সরে যাওয়ার নীতি কোনো স্বাধীন দেশের বিদেশনীতি হতে পারে না।

মুমু

×