
ছবি : সংগৃহীত
সম্প্রতি বিটিভি আয়োজিত ‘আগামীর বাংলাদেশ’ টকশোতে উপস্থিত ছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি। রাজনীতির বর্তমান ধারা, অভ্যুত্থানের চেতনা এবং রাষ্ট্রপুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কড়া ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি। তার মতে, বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা মূলত "আওয়ামী মডেল"-এর প্রতিফলন। এই মডেলের বাইরে বিকাশের সুযোগ পায়নি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও।
রনি বলেন, “আমাদের রাজনীতিতে আওয়ামী মডেলই বিকশিত হয়েছে। বিএনপি, জামায়াতসহ অন্যান্য দলগুলোও আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি অনুসরণ করতে করতে নিজেরাই একেকটি ছোট আওয়ামী লীগে পরিণত হয়েছে। এর ফলে স্বাধীন ও মৌলিক রাজনৈতিক বিকাশ হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, "যদি আওয়ামী মডেলের বাইরে যেতে হয়, তাহলে অভ্যুত্থানের চেতনার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। কারণ, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলন পর্যন্ত অভ্যুত্থানের ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু বর্তমান রাজনীতিতে তা দেখা যায় না।"
রনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আপনারা ৫৪ বছর ধরে এমন এক রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করেছেন, যেখানে তরুণদের বাঁচানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। তারা গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছে, অথচ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এটা কি কোনো দেশ? এটা কি কোনো রাজনৈতিক কাঠামো?”
তিনি ফিলিস্তিনের গাজা স্ট্রিপের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, “এই ধরনের পরিস্থিতি পৃথিবীর কোথাও নেই, গাজার বাইরে বাংলাদেশেই এমন ঘটনা ঘটছে। আমাদের সন্তানদের আমরা হারাচ্ছি, অথচ আমরা গর্ব করছি, লজ্জিত হচ্ছি না।”
সম্প্রতি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, “দেশের সামাজিক অবস্থা বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। সেনাপ্রধানকে পর্যন্ত কড়া ভাষায় বক্তব্য দিতে হয়েছে, যা সাধারণত তাদের করতে হয় না। এটা কি ভালো দেখায়? তাহলে পরিস্থিতি কেন এতটা খারাপ হলো?”
তিনি রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখেন, “আপনারা জানেন আপনাদের শত্রু কে, আপনাদের ক্ষমতা কতটুকু, আপনাদের ৫৪ বছরের ফেইলর কি আপনারা জানেন, তারপরেও আপনারা রিয়ালাইজ করেন না কেন!
রনি মনে করেন, বাংলাদেশে এখন "প্রোঅ্যাক্টিভ ও প্রোডাক্টিভ রাজনীতি" দরকার। তিনি বলেন, “আমাদের রাজনীতি হতে হবে ফিলানথ্রপি-ভিত্তিক। এমন নয় যে, কেউ নেতা হবেন, তারপর ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ২০০০ কোটি টাকা চুরি করবেন, ১০ টাকার উন্নয়ন করেন বা ১০০০০ টাকার উন্নয়ন করবেন। বরং এখনই জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। জনসেবাই রাজনীতির মূল ভিত্তি হওয়া উচিত।”
তিনি অভিযোগ করেন যে, রাষ্ট্র এখন সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। “সরকারি চাকরিজীবীরা নিজেদের ‘বোয়াল মাছ’ মনে করে, সব চিবিয়ে খায়। টেন্ডার ব্যবসায়ীরাও মূল কাজের চেয়ে টাকা কামানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়। অথচ বাংলাদেশ এখনও দরিদ্র দেশ, কিন্তু সরকারি অফিসগুলো অত্যন্ত বিলাসবহুল। যেখানে সাধারণ মানুষ ঠিকমতো পুষ্টিকর খাবার পায় না, সেখানে এত চকচকে অফিসের দরকার কী?”
শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিয়েও রনি কঠোর সমালোচনা করেন। “একটা বুয়েট ছাড়া আমাদের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। অথচ ভারত, পাকিস্তান বা নেপালেও মানুষ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা রাখছে। আমাদের কোনো কার্যকর মানবসম্পদ নেই, কেবল অদক্ষ শ্রমিক তৈরি করা হচ্ছে, যারা বিদেশে গিয়ে পশুর মতো পরিশ্রম করে।”
সমাজের সভ্যতা পরিমাপের জন্য শিশু ও নারীদের প্রতি আচরণকে মূল মাপকাঠি হিসেবে দেখিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে শিশুরা রাস্তায় ১০ মিনিটের বেশি নিরাপদ নয়, নারীদের সন্ধ্যার পর বাইরে বের হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। অথচ পশ্চিমা দেশগুলোতে শিশু রাস্তা পার হলে গাড়ি থেমে যায়, তাদের আগে যেতে দেওয়া হয়।”
রনি মনে করেন, সংস্কার নয়, বরং বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের পুনর্গঠন। তিনি বলেন, “আমাদের রাজনীতি এখন নতুনভাবে সাজাতে হবে। ৫ জানুয়ারির ঐক্যের যে চিত্র আমরা দেখেছি, সেটিকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশ গঠনের জন্য শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রিঅ্যাকশন না করে, বরং তাদের বিচারও করতে হবে। প্রতিটি সেক্টর ধরে ধরে বিচার করা গেলে দেশ সংস্কার হয়ে যাবে।”
সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=XlsU0VG_dZs
মো. মহিউদ্দিন