
ছবি: সংগৃহীত
১৭৮৯ সালের ১৪ই জুলাই, ফরাসি কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সবাই যেন ফুঁসে উঠল। তাদের উপর ছিল মাত্রাতিরিক্ত করের চাপ, খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি আর সামন্তবাদী খামখেয়ালের নিয়ম-কানুন। প্যারিসের বাস্তিল দুর্গ দখল করে সারা দেশকে তারা বুঝিয়ে দিল, রাজতন্ত্র আর আগের মতো শক্তিশালী নেই। শহরের উত্তেজনা ক্রমশ গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে। গুজব ছড়ায় যে অভিজাতদের ভাড়াটে বাহিনী গ্রাম থেকে শস্য ও ধন-সম্পদ লুট করতে আসবে। এই গুজবকে 'গ্রেট ফিয়ার' বলা হয়।
ভয়ে মানুষ নিজেরাই দল বেঁধে জমিদারদের বাড়ি আক্রমণ করে। অনেক জায়গায় নথিপত্র বা সম্পত্তি পুড়িয়ে দেয়। স্থানীয় প্রশাসন প্রায় অচল হয়ে পড়ে। সামান্য উত্তেজনা বা সন্দেহেই গ্রাম-নগরের হাজারো লোক সহিংসতায় ঝাঁপিয়ে পড়তে প্ররোচিত হতো। এভাবেই 'গ্রেট ফিয়ার' সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে ফেলে এবং বিপ্লবের প্রথম দিকের স্বপ্নময় পরিবেশকে আরও তিক্ত করে তোলে।
বিপ্লবী নেতৃত্ব এটাকে সাময়িক উত্তেজনা বলে সামাল দিতে চেয়েছিল। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ও পরে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি রাজতন্ত্রের ক্ষমতা কাটছাঁট করে পুরনো সামন্তবাদী নিয়মগুলো কাগজে-কলমে বিলুপ্ত করে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের মনে হতাশা আর সংশয় থেকেই গেল। শ্রমজীবী মানুষ, যাদের 'সাঁ-ক্যুলট' বলা হতো, তারা রাস্তায় নেমে আরও বেশি সামাজিক ন্যায়বিচার দাবি করে। মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত বিপ্লবী নেতারা একদিকে চেষ্টা করল আইনি সংস্কার আনতে, অন্যদিকে নিজেদের মধ্যেই মতবিরোধ বেড়ে গেল। কেউ রাজাকে টিকিয়ে রেখে সীমিত ক্ষমতার পক্ষে ছিল, আবার কেউ চাইছিল রাজতন্ত্র পুরোপুরি বিলুপ্ত হোক। জিরোন্ডিন আর জাকোবিনদের মধ্যে এই মতপার্থক্য দেশের বৃহত্তর স্বার্থের চাইতেও বড় হয়ে উঠল।
ক্রমে ফ্রান্সকে যুদ্ধের মুখে পড়তে হয় ক্রোয়েশিয়া ও অস্ট্রিয়ার সঙ্গে। তারা আশঙ্কা করল, রাজতন্ত্রপন্থী বিদেশি শক্তি এসে ফ্রান্সের বিপ্লব দমিয়ে দেবে। সন্দেহ, আতঙ্ক আর অসন্তোষের আগুনে প্যারিসে ১৭৯২ সালে রাজতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়। রাজা ষোড়শ লুইকে বিচারের মুখোমুখি করে শিরশ্ছেদ করা হয়। এত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরও শান্তি ফিরল না; বরং পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে উঠল। জাকোবিনরা, বিশেষ করে রোবেস্পিয়ারের নেতৃত্বে, ঘোষণা করল যে শত্রুকে দমন করতে হবে যেকোনো মূল্যে।
এই সময় শুরু হয় 'রেন অফ টেরর'। এই সময় বিশেষ একটি কমিটি—'কমিটি অফ পাবলিক সেফটি'—তৎপর হয়ে ওঠে। কথিত বা বাস্তব, যিনি বিপ্লববিরোধী বা রাজতন্ত্রপন্থী বলে সন্দেহের মধ্যে পড়তেন, তিনিই মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকিতে থাকতেন। কোনো সুষ্ঠু বিচার না করেই গিলোটিনে ঝরে পড়ত মাথা। ফলে সারাদেশে এমন এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হলো, যেখানে মানুষ আর মুখ ফুটে সত্য কথা বলতে সাহস পেত না। বহু মানুষ নিরপরাধ হয়েও শাস্তি ভোগ করল। অনেকে পালিয়ে বাঁচল, আবার কেউ কেউ সুযোগ নিয়ে ব্যক্তিগত শত্রুতা মিটিয়ে ফেলল। গ্রামাঞ্চলে অনেক গোষ্ঠী নিজেদের ইচ্ছামতো শাসন চালাতে লাগল।
আইন-শৃঙ্খলার সব ঐতিহ্য প্রায় ভেঙে পড়ে। মূর্তি ভাঙা থেকে শুরু করে আগের সব স্থাপনা ভাঙচুর চলতে লাগল। একই সঙ্গে রাস্তার নাম থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বদলের জোশ এসে গেল তখন। এমনকি ক্যালেন্ডারও বদলে দেওয়া হলো। নতুন বছর শুরু হলো সেপ্টেম্বর থেকে। সব মাসের নাম বদলে ফেলা হলো। জুলাই মাসের নাম রাখা হলো 'থার্মিডোর'।
১৭৯৪ সালের দিকে রোবেস্পিয়ারের কঠোর ভূমিকা আর লাগামহীন সহিংসতার বিরোধিতা বাড়তে থাকে। বিপ্লবের নামে এভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা বিপ্লবেরই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছিল। তাছাড়া, রোবেস্পিয়ারের ঘনিষ্ঠদের ক্ষমতার দাপট অনেককে আতঙ্কিত করছিল। যে কেউ সামান্য মতপার্থক্য দেখালেই রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে অভিযুক্ত হতে পারত। জুলাই মাস বা তৎকালীন 'থার্মিডোর' মাসে 'থার্মিডোরিয়ান রিয়াকশন' নামে পরিচিত এক ঘটনার মাধ্যমে রোবেস্পিয়ার ও তার প্রধান অনুগামীরা ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং তাদেরও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
অনেকে ভেবেছিল, এই ঘটনার পর বুঝি শৃঙ্খলা ফিরবে, এক নতুন ধারার নেতৃত্ব দেশটাকে গড়ে তুলবে। এরপর যে সরকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তাকে বলা হয় 'ডিরেক্টরি'। পাঁচজন পরিচালকের সমন্বয়ে রাষ্ট্র চালানোর ব্যবস্থা করা হয়। প্রথম দিকে তারা শান্তি ও সুস্থিতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ফ্রান্স তখন অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, বিদেশি যুদ্ধ, দুর্নীতি, কালোবাজারি আর বিপুল আর্থিক চাপের মধ্যে ছিল। রেশনের ঘাটতিতে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসত। অনেক ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে পর্দার আড়ালে চাল-চালাত। যাদের হাতে স্থানীয় বাহিনী বা প্রভাবশালী দলের লোক ছিল, তারা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করত। রাজনৈতিক আদর্শের পার্থক্য ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ডিরেক্টরির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
সরকার বারবার চেষ্টা করেও স্থিতিশীলতা আনতে পারছিল না। ডিরেক্টরি প্রশাসন যতই দুর্বল হয়ে পড়ে, ততই ফ্রান্সের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি নিজেদের সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায় প্রায়শই পড়ত দলের অনুগত শক্তিশালী ব্যক্তিদের উপর, যারা আবার নিজেদের স্বার্থ হাসিলে নানা কায়দায় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত। সাধারণ নাগরিকদের অনেকে এ সময় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কারণ তারা বুঝতে পারছিল না কাকে সমর্থন করলে শান্তি আসবে। অনেকে ভাবতে লাগল, একজন দৃঢ় সামরিক নেতা এলে হয়তো দেশ শান্ত হবে। আর সেখানেই নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান। ১৭৯৯ সালে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ডিরেক্টরিকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন।
ফরাসি বিপ্লবের সূচনা যে মহান আদর্শের জন্ম দিয়েছিল—সাম্য, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব—সেগুলো নৈরাজ্য আর পরস্পরের উপর দোষারোপের জটে হারিয়ে গেল। ফরাসি বিপ্লব শেষ পর্যন্ত দেশকে ঐক্যবদ্ধ ও গণতান্ত্রিকভাবে গড়ে তোলার বদলে এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেল, যেখানে মানুষ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে বাঁচতে সেই ক্ষমতা একটি শক্ত হাতে সমর্পণ করতে বাধ্য হলো। ঘুরে ফিরে সেই একনায়কতন্ত্রেই ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ অর্পিত হলো। তবে এই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে অনেক গণঅভ্যুত্থানের রসদ যুগিয়েছে। এরই জের ধরে ১৮৪৮ সালেই ফ্রান্সে আবার শুরু হয়েছিল জুলাই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারির গণঅভ্যুত্থান।
আবীর