
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী
রাজধানীসহ দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির বিষয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেহেতু তারা প্রচুর টাকা দেশ থেকে স্থানান্তর করেছে, ওই টাকা এখন তারা ব্যবহার করছে। তবে আমরা এটা কোনো অবস্থাতেই করতে দেব না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রবিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে রাজধানীর বারিধারায় নিজ বাসভবনে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। দেশের বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকার সজাগ ও সচেতন আছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, যারা এসব করছেন, তাদের ঘুম আমি হারাম করে দেব। তারা কোথাও স্থান পাবে না।
যেভাবে হোক, দুষ্কৃতকারীদের প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, দিনে-রাতে যেখানে আমাদের বাহিনীর প্রয়োজন হবে, তারা সেখানে যাবে এবং সেখানে প্রতিহত করবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এরইমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমি এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছি। সোমবার থেকে তারা টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি করবে। কোথাও কিছু যেন না ঘটে, এজন্য তারা ব্যবস্থা নেবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এতে কোনো গাফিলতি করলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করবেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও উন্নতি হবে এবং এটা অবনতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে এবং এটা আরও উন্নতি হতে থাকবে।
অপারেশন ডেভিল হান্টের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও জানান স্বরাষ্ট্র্র উপদেষ্টা। এ সময় বনশ্রী এলাকায় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে সাংবাদিকের করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বনশ্রী এলাকার এই ঘটনাটি আমার নলেজে আছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর যদি কারও অবহেলা থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির প্রতিবাদে দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের পর মধ্যরাতেও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গভীর রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, দিনে-রাতে যে বাহিনীর প্রয়োজন হবে তারা সেখানে যাবে এবং প্রতিহত করবে। আওয়ামী লীগের যারা এগুলো করছে, তাদের ঘুম আমি হারাম করে দেব। তারা কোথাও কোনো স্থান পাবে না।
সব বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, তারা টহল কার্যক্রম আরও বাড়াবে। যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভালোভাবে কার্যক্রম করতে না পারে, তাদের বিরুদ্ধেও আমি ব্যবস্থা নেব। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন আরও উন্নতি হবে, অবনতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। দেশকে যারা অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, তাদের কাউকে ছাড় দেব।
সম্প্রতি দেশব্যাপী ধর্ষণ, ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রবিবার রাজধানীসহ সারাদেশে মানববন্ধন, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দিনভর সারাদেশে নানান কর্মসূচি পালন করেছেন।
এরইমধ্যে সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে সশস্ত্র মহড়া, বনশ্রীতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে ডাকাতি এবং মোহাম্মদপুরে রিক্সা আটকে ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যায়। তারপরেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ব্যর্থ উল্লেখ করে তার পদত্যাগ দাবি করে মধ্যরাতে হলপাড়া থেকে মিছিল বের করে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ করেন ঢাবির শিক্ষার্থীরা। তারা সোমবার দুপুরের মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেন।
এরপরই রাত তিনটায় সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। তবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, গভীর রাতে কেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সংবাদ সম্মেলন করতে হলো? সকালে কী সমস্যা হতো? এ ধরনের প্রশ্নের মুখে নেটিজেনরাও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে রাতে একটি ডাকাতির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। প্রকাশ্যে এমন ঘটনা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন রাজধানীবাসী। তারপরেই নেটিজেনরাও তাদের মতামত প্রকাশ করতে থাকেন।
সাংবাদিক হারুন উর রশীদ লিখেছেন, ‘বোকা প্রশ্ন: রাত ৩টায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলন থেকে জাতি কি পেল। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রাত তিনটার সময় যে সাংবাদিকরা প্রেস ব্রিফিংয়ে যাবেন, তারা ঘড়ি মোবাইল, মানিব্যাগ, মাইক্রোফোন ইত্যাদি সাবধানে রাইখেন।’
সাংবাদিক হাফিজ মোল্লা ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘উপদেষ্টাদের সংবাদ সম্মেলন সব সময় গভীর রাতেই হওয়া উচিত। এতে ছিনতাই করে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের অন্তত একটু হলেও সুবিধা হয়। গভীর রাতে ছিনতাইয়ের জন্য বের হলে, কেউ ঠেকালে বলা যাবেÑ উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে যাচ্ছি ভাই।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ব্যাখ্যা ॥ রাতে সংবাদ সম্মেলন করার ব্যাখ্যা দিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেন, দিনে-রাতে সব সময় কাজ করে যাচ্ছেন বোঝাতেই রাত ৩টায় সংবাদ সম্মেলন করেছি। সোমবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা এ কথা বলেন।
পরিস্থিতি যদি ভালোই হতো তবে রাত ৩টা বাজে কেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ব্রিফিং করতে হলো- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আগের সিস্টেমে হলে রাত আড়ইটায় কিন্তু আপনাদের কাউকে খুঁজেও পেতাম না। আমি আধা ঘণ্টা আগে আপনাদের বলেছি, আপনারা সবাই হাজির হয়েছেন। আমরা জানি দিন-রাত আপনারা কাজ করে যাচ্ছেন।
এ সময় উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক দাবি করতেই একজন সাংবাদিক প্রশ্ন রাখেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি ভালোই হতো তবে আপনার পদত্যাগের দাবি কি উঠতো? এ বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, আপনি তো শুধু বললেন পদত্যাগ। আমার তো কুশপুতুল দাহ হয়েছে, দাফন হয়ে গেছে। পদত্যাগ চাওয়া তো কম হয়েছে। আমার তো জানাজাও হয়ে গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাকরি করার পর জীবিত থাকা অবস্থায় জানাজার সওয়াব পেয়েছি।
রবিবার রাতে রাজধানীতে কয়েকটি ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে মিছিল করেন রাতে। এ পরিস্থিতিতে রাত ৩টায় নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
এটা আপনাদের বোঝাতে চাই যে, আমরাও দিনে-রাতে সব সময় কাজ করে যাচ্ছি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শুধু দিনে ব্রিফ করেন না, দরকার হলে তিনি রাতেও ব্রিফ করেন।