
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর বর্ধিত সভা করতে যাচ্ছে বিএনপি। ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য এ বর্ধিত সভায় প্রাধান্য পাচ্ছে ৫ ইস্যু। সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত থাকবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এদিকে বর্ধিত সভা হওয়ার কারণে শীঘ্রই দলটির জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না।
সূত্র মতে, বিএনপির বর্ধিত সভায় যে ৫ ইস্যু প্রাধান্য পাবে- ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন, ৩১ দফা সংস্কার, নেতা-কর্মীদের সকল মামলা প্রত্যাহারে করণীয় ও অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হলে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ। এছাড়া জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশল পর্যবেক্ষণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ এবং জিও পলিটিক্সও আলোচনায় স্থান পাবে। এসব ইস্যুতে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য গুরুত্বসহ বিবেচনা করা হবে।
দীর্ঘ ৯ বছর জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না বিএনপির। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ রাজধানীতে জাঁকজমকভাবে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গঠন করা হয় দলের ৫৯২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি। তাই জাতীয় কাউন্সিল করার লক্ষ্যে নতুন উদ্যমে এ বছর জানুয়ারি মাস থেকে সারাদেশের সকল জেলা-উপজেলাসহ সর্বস্তরে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে বিএনপি।
ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সকল ইউনিট কমিটি গঠনের কাজ শেষ হবে বলে বিএনপির উচ্চ পর্যায় থেকে জানানও হয়েছিল। এও বলা হয়েছিল, সর্বস্তরে দল পুনর্গঠনের কাজ শেষ করে জাতীয় কাউন্সিল করা হবে। তাই দলের বেশিরভাগ নেতা-কর্মী মনে করেছিল শীঘ্রই বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হবে এবং নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। কিন্তু জাতীয় কাউন্সিলের দিনক্ষণ ঠিক না হলেও ২৭ ফেব্রুয়ারি দলের বর্ধিত সভা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতেই মনে হচ্ছে, শীঘ্র বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হবে না।
বিএনপির গঠনতন্ত্রের ১১(চ) অনুচ্ছেদ অনুসারে- যে বছর জাতীয় কাউন্সিল হবে সে বছর ব্যতীত প্রতিবছর অন্তত একবার জাতীয় নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। দলের গঠনতন্ত্রের এ অনুচ্ছেদ থেকে সহজেই অনুমেয়, যেহেতু ২৭ ফেব্রুয়ারি বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছে সেহেতু বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল শীঘ্র হচ্ছে না।
এদিকে বিএনপি হাইকমান্ড ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভাটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ জন্য দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীকে আহ্বায়ক করে ২৭ সদস্যের বর্ধিত সভা বাস্তবায়ন কমিটি এবং ছয়টি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি গঠনের পর থেকে বর্ধিত সফা সফল করতে প্রস্তুতি জোরদার করা হচ্ছে বলে জানা যায়।
রুহুল কবীর রিজভীর নেতৃত্বাধীন বিএনপির বর্ধিত সভা বাস্তবায়ন কমিটিতে সদস্যরা হলেনÑ খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, আব্দুস সালাম আজাদ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল, কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল, মাহবুবের রহমান শামীম, সৈয়দ শাহীন শওকত, আসাদুল হাবিব দুলু, জি কে গউছ, অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া, শরিফুল আলম, শামা ওবায়েদ, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, আজিজুল বারী হেলাল, এ বি এম মোশাররফ হোসেন, রকিবুল ইসলাম বকুল, মীর শরাফত আলী সপু, প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান, ডা. রফিকুল ইসলাম, রফিকুল আলম মজনু ও আমিনুল হক।
আরও রয়েছে ছয়টি উপকমিটি। এর মধ্যে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকে আহ্বায়ক করে ব্যবস্থাপনা উপকমিটি; হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে আহ্বায়ক ও মো. আবদুস সাত্তার পাটোয়ারীকে সদস্য করে অভ্যর্থনা উপকমিটি; এম রশিদুজ্জামান মিল্লাতকে আহ্বায়ক করে আপ্যায়ন উপকমিটি; সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে আহ্বায়ক করে শৃঙ্খলা উপকমিটি; ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেলকে আহ্বায়ক করে মিডিয়া উপকমিটি এবং ডা. রফিকুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে চিকিৎসা সেবা উপকমিটি।
বিএনপির বর্ধিত সভা বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক দলের মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর জানান, নেতা-কর্মীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল, তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের নেতারা এক জায়গায় বসে সভা করার। অনেকদিন পর হলেও সেই প্রত্যাশা পূরণে বর্ধিত সভা করতে যাচ্ছি আমরা।
বর্ধিত সভা কাউন্সিলের বিকল্প কি না, জানতে চাইলে রিজভী বলেন, না, বর্ধিত সভাটি কাউন্সিলের বিকল্প নয়। যে কোনো আন্দোলনের শেষে, নির্বাচনের শেষে অথবা প্রারম্ভে নেতা-কর্মীরা কী ভাবছেন তাদের মতামত জানার জন্য বর্ধিত সভা করা হয়। বর্ধিত সভায় তৃণমূলের নেতাদের ভাবনা-চিন্তাগুলো জাতীয় নেতারা শুনবেন, অবহিত হবেন, এ কারণেই বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছে।
এদিকে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল প্রাঙ্গণে ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় বিএনপির বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। বর্ধিত সভায় আমন্ত্রণ পেতে নেতাদের ছোটাছুটিও শুরু হয়ে গেছে। তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী ইতোমধ্যেই কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছেন।
এছাড়া কেন্দ্রীয় নেতারা নিজ নিজ সংসদীয় এলাকার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে সাংগঠনিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানে কি করা যায় সে সম্পর্কে এলাকাবাসীর মতামত নিচ্ছেন। এ ছাড়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার এবং সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে কি করতে হবে সে বিষয়ে দলীয় হাইকমান্ডের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। আর বিএনপির ৩১ দফা সম্পর্কে দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ঘরে ঘরে বার্তা পৌঁছে দিতে বলেছেন এবং বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তা বাস্তবায়ন করা হবে বলে সবাইকে জানিয়ে দিতে বলেন।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, ২৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির বর্ধিত সভা ডাকায় শীঘ্রই জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না বিধায় এই সভায় নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের অনুমোদন নেওয়া হতে পারে। সে মোতাবেক নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে বিএনপির নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন অথবা বর্তমান কমিটিতে শূন্য পদগুলো পূরণ করে কমিটি পুনর্গঠন করা হতে পারে। আর এ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নির্বাহী কমিটির পদ প্রত্যাশী নেতারা দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছেন।
এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের গুডবুকে থাকা নেতাদের কাছে বিরামহীন দৌড়ঝাঁপ করছেন। আবার দলীয় হাইকমান্ডও বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর রাখছেন, কারা দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। অতীতে যাদের ব্যর্থতার কারণে দল বিভিন্নভাবে হোঁচট খেয়েছে, তাদের সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখছে দলীয় হাইকমান্ড।
সূত্র জানায়, এর আগে ১৯৯০ সালে বিএনপির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে। এর ৩৫ বছর পর ২৭ ফেব্রুয়ারি বর্ধিত সভা হতে যাচ্ছে। তবে ১৯৯০ সালের পর আর বর্ধিত সভা না হলেও দলের সর্বশেষ নির্বাহী কমিটির সভা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি।
রাজধানীর এয়ারপোর্ট সংলগ্ন পাঁচতারকা হোটেল লা মেরিডিয়ানে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের নেতাদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রেখেছিলেন। এর ৫ দিন পর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাবন্দি হন।
চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। ৮ জানুয়ারি তিনি লন্ডনে গিয়ে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হন। ১৭ দিন লন্ডন ক্লিনিকে চিকিৎসার পর তিনি ছেলের বাসায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অবস্থান করছেন। তার বড় ছেলে ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে লন্ডনে অবস্থান করছেন। ২৭ ফেব্রুয়ারির আগে তাদের দু’জনেরই দেশে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে তারা দু’জনই বিএনপির বর্ধিত সভায় ভার্চুয়ালি সংযুক্ত থাকবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপি কার্যালয় সূত্র জানায়, দলের জাতীয় কাউন্সিল হলে যারা উপস্থিত থাকেন তাদের প্রায় সবাইকে বর্ধিত সভায় আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজারের মতো ডেলিগেট বর্ধিত সভায় অংশ নেবেন। এর মধ্যে থাকবেন স্থায়ী কমিটির সকল সদস্য, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সকল সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপারসনের সকল উপদেষ্টা।
এ ছাড়া থাকবেন সকল মহানগর ও জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব। আরও থাকবেন সকল থানা, উপজেলা ও পৌরসভা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব। থাকবেন বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা।
এছাড়া দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা বিএনপির প্রার্থী ছিলেন তারাও বর্ধিত সভায় অংশ নেবেন। দলের জাতীয় কাউন্সিল হলে মোট কাউন্সিলরের শতকরা ১০ ভাগ বিএনপি চেয়ারপারসন গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে বাড়িয়ে নিতে পারেন। এবারের বর্ধিত সভায়ও বিএনপি চেয়ারপারসন মনে করলে আরও ১০ ভাগ দলীয় নেতাকে ডেলিগেট বানিয়ে সভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ দিতে পারবেন বলে সংশ্লিষ্ট দলীয় সূত্র জানান।