বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৪৮ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আজ। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ হতে মাত্র ছয় জন মিলে যাত্রা শুরু করেছিল। বর্তমানে সারা দেশে কয়েক লাখ নেতাকর্মীর সংগঠনে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানান ধরনের হামলা নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে বছরের পর বছর অতিক্রম করেছে সংগঠনের নেতাকর্মীরা। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ছাত্র-জনতার পাশে থেকে লড়াই করেছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এ আন্দোলনে অন্যান্য ছাত্র সংগঠন নিজেদের নিহত নেতাকর্মীদের তথ্য প্রকাশ করলেও নিজ দলের নেতাকর্মীদের তথ্য প্রকাশ করেনি ছাত্রশিবির। তবে সংগঠনটির বেশ কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে চব্বিশের গনঅভূত্থানে ৮৭৪ জন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী শহিদ হয়েছেন। এর বাহিরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং প্রশাসনের হামলার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ২৩৪ জন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী। এছাড়াও আওয়ামী লীগের শাসন আমলে গুমহন একহাজারেরও বেশি নেতাকর্মী এর মধ্যে এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ৭ জন নেতাকর্মী।
১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও আশির দশকে ইসলামী ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সক্রিয় হতে থাকে। এ সময়ে বেশকিছু সহিংসতা ও হত্যার ঘটনাও ঘটে। এর মধ্যে ১৯৮২ সালের ১১ই মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটির নবীন বরণ অনুষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। হামলায় শিবিরের কর্মী সাবিবর আহমদ, আবদুল হামিদ, আইয়ুব আলী, আবদুল জাববার নিহত হয়। এই ঘটনার জন্য তৎকালীন ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র মৈত্রীকে দায়ী করা হয়। তাই শিবির প্রতিবছর এই দিনটিকে ‘শহিদ দিবস’ হিসেবেও পালন করে। ১৯৮২ সালের পর বিভিন্ন সময় আরও ২৩০ জন নেতাকর্মী নিহত হন।
ছাত্রশিবিরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য যাচাই বাছাই করে দেখা যায়, ২৩৪ জন নেতাকর্মীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যার শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় এখন পর্যন্ত ৮৮ জন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ। ছাত্রদলের হাতে নিহত হয়েছে ৩২ জন। জাতীয় ছাত্র সমাজের হাতে ৫ জন। অন্যান্য বাম সংগঠনের হাতে ২২ জন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ৮৭ জন, ছাত্রলীগের হাতে ৮৮ জন, ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী।
আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ছিলো ছাত্রশিবিরের সাথি হাফেজ রমজান আলী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সেক্রেটারি শরীফুজ্জামান নোমানী হত্যা। ২০০৯ সালের ৯মার্চ মাগরিবের নামাজ পড়ে বাসায় যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে হত্যা করে ছাত্রশিবিরের সাথি হাফেজ রমজান আলীকে। এই ঘটনার তিনদিন পর ১৩ মার্চ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সন্ত্রসীরা নির্মমভাবে হত্যা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সেক্রেটারি শরীফুজ্জামান নোমানীকে। ক্যাম্পাসে সেই হত্যার রাজনীতি সর্বশেষ ২৪ সালের অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত চালিয়েছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রশিবিরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে দেখা যায়- ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৯৯ জন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা।
ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে ২৩৪ জন নেতাকর্মী হত্যার বিষয়টি শিকার করে বলেন, ‘এই ৪৮ বছরের পথ পরিক্রমায় আমাদের অনেক অর্জন, অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে জায়গাটি তা হচ্ছে আমাদের শহিদদের ইতিহাস রচিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমাদের ২৩৪ জন ভাই শাহাদৎ বরণ করেছেন। এরমধ্যে আমরা যদি বলি- জাতীয় ছাত্র সমাজের হাতে ৫ জন, ছাত্রদলের হাতে নিহত হয়েছে ৩২ জন, ছাত্রলীগের হাতে ৮৮ জন, অন্যান্য বাম সংগঠনের হাতে ২২ জন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে শাহাদাৎ বরণ করেন ৮৭ জন।’
জাহিদুল ইসলাম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমাদের অনেক ভাই শাহাদাৎ বরণ করেছেন। সঙ্গতকারণে আমরা আগে থেকেই বলে আসছি দলীয়ভাবে আমরা আমাদের ভাইদের নাম প্রকাশ করবো না। এই আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছে আমরা সবাইকে ধারণ করবো। যারা নিহত হয়েছে তারা সবাই জাতীয় শহিদ।
গুমের বিষয়ে জাহিদুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছরে আমাদের এক হাজারেরও অধিক নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছিল। এর মধ্যে অনেককে হত্যা করা হয়েছে। যারা ফিরে এসেছেন তারা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এখন পর্যন্ত ৭ জন নেতাকর্মী এখনও ফিরে আসেনি। ৫ আগস্টের পর প্রশাসন বিভিন্ন আয়না ঘরের তথ্য দিলেও এখন আর দিচ্ছে না।
এসব হত্যা এবং গুমের বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি চলছে উল্লেখ করে ছাত্রশবির সভাপতি বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে ২০টি মামলা করেছিলাম। এরমধ্যে আগে যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তাদের প্রভাবে বেশিরভাগ মামলা বাতিল হয়ে যায়। এর বাহিরে কিছু কিছু মামলায় প্রশাসন মিথ্যা প্রতিবেদন জমা দেন। আমরা নতুন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নতুন করে মামলা দায়ের করা হবে।
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রকাশ্যে স্বাধীনভাবে সংগঠন কার্যক্রম শুরু করেছে ছাত্রশিবির। গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব বাছায় করে সংগঠনটি।
ছাত্রশিবির ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। যার মধ্যে কেন্দ্রের উদ্যোগে ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাবির বটতলায় অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা ও প্রদর্শনী। শাখা পর্যায়ে বর্ণাঢ্য র্যালি আয়োজন। ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় র্যালি। অদম্য মেধাবীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান। সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও এতিম ছাত্রদের নিয়ে প্রীতিভোজ। ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান/কালচারাল ফেস্ট আয়োজন। কুইজ, বিতর্ক, বক্তৃতা, ক্রীড়া, শর্ট ফিল্ম ও ক্যালিওগ্রাফি প্রতিযোগিতা আয়োজন। ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প, ব্লাড গ্রুপিং ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালন। শহিদ ও আহত-পঙ্গুত্ববরণকারী পরিবারের সাথে প্রীতিভোজ ও শহিদদের জন্য দোয়া। দাওয়াতি মেসেজ, গান, নাটক, শর্ট ফিল্ম ও ডকুমেন্টারি প্রভৃতি তৈরি ও প্রচার। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়। বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যাম্পাস শাখাসমূহে ডিপার্টমেন্টভিত্তিক পজিশনধারীদের সংবর্ধনা। জুলাই অভ্যুত্থানের ডকুমেন্টারি প্রদর্শন। আলোচনা সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম আয়োজন।
বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ৯ আহ্বান জানান। যার মধ্যে রয়েছে- শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণে অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাধীন শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। জুলাই গণহত্যা, ২৮ অক্টোবর, পিলখানা ও শাপলা চত্বরসহ সকল হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিচারকার্য দ্রুত শেষ করতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান এবং আহতের যথাযথ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে এবং সকল ধরনের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসরদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। বিগত ১৫ বছরে দায়েরকৃত সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ও রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় সকল রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
ইসরাফিল/ফুয়াদ