ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ মাঘ ১৪৩১

সাক্ষাৎকারে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল

নির্বাচনের আগেই চব্বিশের গণহত্যার বিচার আবশ্যক

জনকণ্ঠ

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

নির্বাচনের আগেই চব্বিশের গণহত্যার বিচার আবশ্যক

মিয়া গোলাম পরওয়ার

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হঠাৎ জামায়াতের প্রতি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বেড়েছে একইসঙ্গে গণমাধ্যমে জামায়াতের গুরুত্ব বেড়েছে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন ?
মিয়া গোলাম পরওয়ার ॥ আলহামদুলিল্লাহ, এখানে জামায়াতের কোনো কৃতিত্ব নাই, এটা আল্লাহ তায়ালার খাস মেহেরবানি। গত ১৫ বছরে জামায়াত প্রকাশ্যে মিটিং করতে পারেনি, জনগণের কাছে যেতে পারেনি, আমাদের সুধী শুভাকাক্সক্ষীরা আমাদের কাছে আসতে পারেনি। ফলে ৫ তারিখের পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রকে যে রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে নাগরিকরা তা ভোগ করছে।

ফলে একইভাবে জামায়াতও সেই সুযোগ পেয়েছে। জুলাই বিপ্লবে হাজার হাজার শহীদের বাড়িতে শুরুতেই আমরা গিয়েছি। জামায়াত আমিরসহ আমরা সারাদেশে সফর করেছি। বন্যায় আমরা সফর করেছি। যেখানেই আমরা গিয়েছি  সেখানে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়েছে, জনসভায় রূপান্তরিত হয়েছে। তখন আমরা আমাদের দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছি। কেমন বাংলাদেশ আমরা চাই, আমরা যে ‘নতুন বাংলাদেশ’ বলছি এ নতুন বাংলাদেশ কেমন হবে সেই ধারণা তো আমরা জাতিকে দিতে পারি নাই।

এখন আমরা তা দিতে পারছি। একটা সময় গণমাধ্যম জামায়াত থেকে দূরে থাকত, যে জামায়াতের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে চাইত না একটা বিবৃতি দিলে ভেতরে কোনায় এক কলামে দিত বা প্রকাশই করত না। এখন তারাই ইন্টারভিউ নিচ্ছে। আমরা কথা বললে কভারেজ পাচ্ছি। সাধারণ মানুষ জামায়াতের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে, নেতৃত্বের ব্যক্তিত্ব ওজনকে সরাসরি দেখতে পারছেন আল্লাহ তায়ালার মেহেরবাণীতে।

আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তরকে জামায়াতের প্রতি শুভ্র করেছেন, জামায়াতের আবেদন তাদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। মানুষের অন্তরে এ ভালোবাসা দিয়েছে, যে কারণে আমাদের মিটিংগুলোতে হাজার হাজার মানুষ হয়, এটা আল্লাহর মেহেরবান। তারপরও হয়ত আমাদের দুর্বলতা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের নেতৃবৃন্দের ত্যাগ সত্ত্বেও তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, শহীদ হয়েছে।

অনেকেই কারাবরণ করেছেন, শত নির্যাতনে আহত ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। এর প্রতি জনগণের যে সহানুভূতি এতদিন পায়নি এখন পাচ্ছে। আপনি যে প্রশ্নটা করলেন কেন মানুষ এতটা জামায়াতকে নিয়ে আশা-আকাক্সক্ষা করছে, মানুষ ঝুঁকে পড়েছে- আমরা মনেকরি এসব কারণে জনগণ জামায়াতের ওপর ঝুঁকে পড়ছে। 
জনকণ্ঠ ॥ জুলাইয়ের আন্দোলন দল-মত-নির্বিশেষে সকল মানুষের আন্দোলন ছিল। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যায় মানুষ দুই ভাগ হয়ে গেছে। সামনে থেকে যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা আগে বিচার ও সংস্কার তারপর নির্বাচন চান আর রাজনৈতিক দলগুলো সামান্য সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে। এ বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন ? 
মিয়া গোলাম পরওয়ার ॥ আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। আমরা চাই, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের বিচার করে তারপর নির্বাচন। নির্বাচন আমরাও দ্রুত চাই। তবে সেটা অবাধ নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সেটার জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। আর এজন্য দরকার ইলেকশন, জুডিশিয়াল, সংবিধান, পুলিশসহ ৬-৭টি জায়গায় সংস্কার। এটা না করলে নির্বাচন ১৪, ১৮ ও ২৪-এর মতোই হবে।

সেই জন্য আমরা বলছি, আপনি সামান্য সংস্কার করে নির্বাচন দেন তাতে আপনার বেশি সময় লাগবে না। সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দিন। তাতে এ বছরের শেষ বা আগামীবছরের মাঝামাঝি হলেও আমরা ‘আন হ্যাপি’ হব না। আমরা ১৫ বছর অপেক্ষা করেছি। দুই এক মাস আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে কি না। নিরপেক্ষ হলে দুই চার মাস কোনো ব্যাপার না। এজন্য আমরা যে নির্বাচন চাই সেটার জন্য যৌক্তিক সময় দিতে রাজি। 
জনকণ্ঠ ॥ নিহত ও আহত পরিবারে সদস্যরা চাচ্ছেন আগে হত্যাকা-ের বিচারÑ আপনারা কোনটা চাচ্ছেন ?
মিয়া গোলাম পরওয়ার ॥ আমরাও চাই নির্বাচনের আগে চব্বিশের গণহত্যার বিচার আবশ্যক- এটা আমাদের প্রথম কথা। তবে সংস্কার বিলম্বিত হোক এটাও আমরা চাই না। 
জনকণ্ঠ ॥ জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছেন ? 
মিয়া গোলাম পরওয়ার ॥ সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। তবে আওয়ামী লীগকে এ দেশের মানুষ মেনে নেবে না। কারণ তারা যে নিষ্ঠুরতা-বর্বরতা মানুষের সঙ্গে করেছে তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। ওই আওয়ামী লীগকে এ দেশের জনগণ আর মেনে নেবে না।
জনকণ্ঠ ॥ যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে গণমাধ্যমে যে প্রচারণা চলছে এটা কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন ?
মিয়া গোলাম পরওয়ার ॥ এটা এখন অপ্রাসঙ্গিক, ওটা বাসি পচা হয়ে গেছে। এটা আওয়ামী লীগের ইস্যু ছিল, এটা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক হত্যাকা-, ওটা কোনো বিচারই নয়। এখন এটা নিয়ে কেউ যদি নাড়াচাড়া করে মজা পায় তাহলে পাবে। তবে জনগণ ওটা যেভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, এটাও প্রত্যাখ্যান করবে। উন্নয়ন অগ্রযাত্রার জন্য এগুলো এখন কোনো ইস্যুই নয়।
জনকণ্ঠ ॥ আপনারা বলছেন জুডিশিয়াল কিলিং হয়েছে, সেই সমস্ত হত্যাকা- নিয়ে আপনারা কোনো রিভিউ করবেন কি না ?
মিয়া গোলাম পরওয়ার ॥ হ্যাঁ, আমরা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। তবে বিদ্যমান আইনে তা সম্ভব নয় অর্থাৎ এই ট্রাইব্যুনালে এমন কোনো বিধান নেই। কারণ, আওয়ামী লীগ একটি সাজানো গোছানো মিথ্যা ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সমস্ত ধাপগুলো দিয়ে এই বিচারগুলো করেছে। তাই রিট করে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে তা পরিবর্তন করা যায় কি না তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি।
জনকণ্ঠ ॥ বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো দূরত্ব দেখছেন কি না ?
মিয়া গোলাম পরওয়ার ॥ না, আমরা কোনো দূরত্ব দেখছি না। বিএনপির হাই কমান্ডের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। বিএনপির থার্ড ফোর্থ লাইনের নেতাদের বক্তব্যকে আমরা বিএনপির বক্তব্য মনে করছি না। তারা মিডিয়ার লাইমলাইটে আসার জন্য মিডিয়ায় বোমা ফাটায়।

তবে নির্বাচন আসলে রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে পক্ষে বিপক্ষে কথা হয়, প্রতিযোগিতা হয়, এটাও গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। আমরা সেটাকে দলের সঙ্গে দলের দূরত্ব মনে করছি না। তবে কিছু কিছু মিডিয়া টেম্পারিং করে নিউজ প্রচার করে যাতে করে বিএনপি-জামায়াতের দূরত্ব তৈরি হয়। যাতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ স্পেস পায়।
জনকণ্ঠ ॥ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে এই বিষয়ে আপনার মতামত কী ?
মিয়া গোলাম পরওয়ার ॥ এগুলো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। কিছু এজেন্সি ও আওয়ামী দোসররা পরিকল্পিতভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে, নির্বাচনকে বিলম্বিত করা, অরাজকতা তৈরি করে আওয়ামী লীগকে দেশে আনার জন্য ইন্ধন দিচ্ছে।
জনকণ্ঠ ॥ আগামীর বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান ?
মিয়া গোলাম পরওয়ার ॥ একটি ইনসাফভিত্তিক কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র দেখতে চাই। যেখানে মানুষের অধিকার থাকবে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থাকবে। রাজনৈতিক, আইন আদালতে মানুষের স্বস্তি ও স্বাধীনতা থাকবে, কোনো জনদুর্ভোগ থাকবে না। নারী শিশু, অমুসলিম সকলে যার যার অধিকার পাবে। 
জনকণ্ঠ ॥ সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। 
মিয়া গোলাম পরওয়ার ॥ আপনাকেও ধন্যবাদ। আশা করছি জনকণ্ঠ দেশ ও মানুষের পক্ষে ভালো ভূমিকা পালন করবে।

×