বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপিও সরকারের কাছে প্রস্তাব দিচ্ছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐক্যের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত দলের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তবে তা চূড়ান্ত করতে গিয়ে তারা সংবিধানের বাইরে যাবে না। প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে ১৬ বছরের আন্দোলনকে। সবার ওপরে স্থান পাচ্ছে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ।
সূত্র জানায়, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপি প্রথমে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকলেও একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সবার ঐক্যের স্বার্থে অবস্থান পরিবর্তন করে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়ার পর থেকে একটি খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু করে বিএনপি।
দলের একজন সিনিয়র নেতাকে ‘জাতীয় ঐকমত্যের রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র’ শিরোনামের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হলেও আরও কয়েকজন নেতাও এর পেছেনে কাজ করছেন। এছাড়া অতীতে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী দলগুলোর মতামতও নেওয়া হচ্ছে। তবে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা নিয়ে বিএনপি তাড়াহুড়া করবে না। ভালো করে বুঝেশুনে সর্বমহলের মতামত নিয়ে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেবে।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র নিয়ে বিভিন্ন মহলের মতামত নেওয়া হচ্ছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামতও নেওয়া হচ্ছে। কারণ, সংবিধানের বাইরে গিয়ে বিএনপি কিছু করবে না।
জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিএনপি নেতারা মনে করছেন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির অবদান রয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এর পর ১৯৭৫ সালের গণঅভ্যুত্থান, ’৯১-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, আওয়ামী লীগ বিরোধী ১৬ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলন ও ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে বিএনপি। তাই এসব আন্দোলন-সংগ্রামের কথা মাথায় রেখে জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র তৈরি নিয়ে নিজস্ব প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছে বিএনপি।
বিএনপির ঘোষণাপত্রের খসড়ায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৬ বছরের আন্দোলনসহ দেশের স্বার্থে করা অতীতের সকল আন্দোলন-সংগ্রাম এবং তা করতে গিয়ে গুম-খুন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সব ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, গণহত্যায় জড়িতদের দ্রুত উপযুক্ত বিচারের কথা বলা হয়েছে।
সেই সঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কিছু সংস্কার করার পর দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠনের কথা বলা হয়েছে। আর নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে আলোচনা করে রাষ্ট্র মেরামতের জন্য সাংবিধানিক সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় অন্য সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় ৬ মাস পর গত ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির। তার একদিন আগে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করা হবে। এর কিছুদিন পর ঘোষণাপত্র ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলসহ সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে বৈঠক করেন।
বৈঠকে অংশ গ্রহণকারী অধিকাংশ দল ও অন্য স্টেকহোল্ডার দ্রুত জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবি জানালেও বিএনপি ঘোষণাপত্রের জন্য সময় চায়। সেইসঙ্গে বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সব রাজনৈতিক ও সংগঠনের ঐকমত্য ছাড়া ঘোষণাপত্র প্রকাশ করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
এর পর বিএনপি এই ঘোষণাপত্র তৈরির বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে বলা হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এ পর্যন্ত দেশ ও দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে সেগুলোর কোনোটিকে বাদ দিয়ে বিএনপির পক্ষে পথ চলা সম্ভব নয়। বিশেষ করে যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করবে তাদের নিয়েই পথ চলবে বিএনপি। ১৯৭১ কে বাদ দিয়ে শুধু ২০২৪ সালের বিপ্লবকে ধারণ করে কিছু করলে তা টেকসই হবে না।
বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং ছাত্র প্রতিনিধিদের খসড়া ঘোষণাপত্রে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে এটি কার্যকর হবে বলে বলা হলেও এ বিষয়ে বিএনপির দ্বিমত রয়েছে। ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপির বিরোধ না থাকলেও শুধু ৩৬ দিনের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়নি।
এর আগে ১৬ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বহু মানুষ জীবন দিয়েছেন। দল হিসাবে বিএনপি সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এমনকি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানেও বিএনপির ৪২২ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছে। অসংখ্য নেতাকর্মী আহত ও মামলা-গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছে।
সূত্র মতে, ১৬টি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিএনপি ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেছে। এর শিরোনামে ‘জাতীয় ঐকমত্যের রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র’ লেখা রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির তৈরি করা ঘোষণাপত্রের যে খসড়া তার সঙ্গে বিএনপির খসড়ার অনেক পার্থক্য রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, দলের একটি বড় অংশ প্রথমে জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র প্রকাশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। পরে বাস্তবতার আলোকে এবং বৃহত্তর ঐক্য ধরে রাখার স্বার্থে ঘোষণাপত্র প্রকাশের পক্ষে অবস্থান নেয়।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির তৈরি করা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে বিএনপির তৈরি করা ঘোষণা পত্র মিলবে না। কারণ, বিএনপি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে এবং স্বাধীনতার পর দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে সেগুলোকে বিবেচনায় রেখে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করবে।