ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ নির্বাচন এবং শপথ অনুষ্ঠিত সম্পন্ন

খেলাফত মজলিসের ৫ প্রস্তাব

প্রকাশিত: ১৭:৫২, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

খেলাফত মজলিসের ৫ প্রস্তাব

ছবি : সংগৃহীত

আজ সকাল ৯টায় শাহজাহানপুর মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা অধিবেশনে ২০২৫-২৬ সেশনের জন্য ১১৮ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ নির্বাচন করা হয় এবং শপথ অনুষ্ঠিত হয়।

দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত উক্ত অধিবেশনে সংগঠনের সারাদেশের কাজের পর্যালোচনা করা হয়। এছাড়াও ৫টি বিষয়ে প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো হলো:
 

প্রস্তাব-১: শোক প্রস্তাব

খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সাধারণ অধিবেশন ২০২৫ জুলাই-আগস্ট জুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামীলীগ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত এবং পরবর্তিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী সকল শহীদ, খেলাফত মজলিস মাদারীপুর জেলা সাধারণ সম্পাদক মাওলানা দেলোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম মহানগর খুলশী থানা সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মাহমুদুল হাসান, পটুয়াখালী বাউফল উপজেলা সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ মাওলানা মোঃ ইউনুস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে উপদেষ্টা হাসান আরিফ ও খুলনার বিশিষ্ট আলেম মাওলানা রফিকুর রহমানের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করছে এবং সকলের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত কামনা করছে। 

 

প্রস্তাব-২: স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য প্রসঙ্গ

খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সাধারণ অধিবেশন ২০২৫ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, ৫ আগস্ট ২০২৫ গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তিতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী একের পর এক অপতৎপরতা পরিচালিত হচ্ছে। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের বিদেশী প্রভুর ইন্ধনে বিগত মাসগুলোতে দেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা, বিভিন্ন অন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজধানীতে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হয়েছে। আমরা দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে এসব অপতৎপরতার তীব্র নিন্দা জানাই। দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সূচনা ঘটিয়েছে তা যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী ও ফ্যাসিবাদ পুনপ্রতিষ্ঠার যে কোন অপচেষ্টা দেশপ্রেমিক জনতা রুখে দিবে ইনশাআল্লাহ। 

দলীয় মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ন্যুনতম জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে গণ-অভ্যুত্থানের সুফল আসবে না। দেশ আবারো গভীর খাদের কিনারায় পৌঁছাবে যেখান থেকে উত্তরণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

‘বিভেদ নয় ঐক্য, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ এই প্রতিপাদ্যে বিগত ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ঐতিহাসিক সোরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিস সাধারণ পরিষদের দ্বাদশ অধিবেশন আয়োজন করে। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এই প্রথম দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ খেলাফত মজলিসের আহ্বানে এক মঞ্চে এসে ঐক্যের কথা বলেছেন এবং পরবর্তীতে সংলাপে অংশ নিয়েছেন।

খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সাধারণ অধিবেশন মনে করে, দলীয় মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে আন্তদলীয় সংলাপ অব্যাহত থাকা দরকার। প্রকাশ্যে বিভেদ ও কাদা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ করে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য সুসংহত করা সময়ের অপরিহার্য্য দাবি।


প্রস্তাব-৩: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বিভিন্ন সংস্কার কমিশন ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গ

খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সাধারণ অধিবেশন ২০২৫ লক্ষ্য করছে যে, গণধিকৃত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৯ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। খেলাফত মজলিস সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি নতুন উপদেষ্টাদের শপথ পাঠ করান। বিশাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে পথচলা শুরু করলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলতা আনতে সক্ষম হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

আবার কিছু অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে তাদেরকে সমালোচনারও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিতর্কিত ব্যক্তিদের উপদেষ্টা নিয়োগ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অর্থনৈতিক সংকট সহ বেশ কিছু জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বেশ কিছু দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। 

এই সরকার ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসরদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় এখনো দাঁড় করাতে পারেনি। জুলাই গণহত্যার দায়ে গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোন চার্জশিট জমা দিতে পারেনি। ৫ মে গণহত্যা সহ খুনী হাসিনার আমলে সংঘটিত সকল গুম ও হত্যাকাণ্ডের আসামীদের বিরুদ্ধে এখনো সুস্পষ্ট সাক্ষীপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি প্রসিকিউশন।

বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আলেম-উলামা ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। নতুন করে মামলাবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার শিকার হচ্ছে লোকজন। ফ্যাসিস্টের তাবেদার কিছু আমলা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রশাসনে এখনো ঘাপটি মেরে রয়েছে। শহীদ ও আহত বেশ কিছু পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগীতার অভিযোগ উঠেছে। প্রায় শতাধিক পণ্যের উপর অতিরিক্ত কর ও ভ্যাট আরোপের প্রজ্ঞাপন জারি করে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করা হয়েছে। এখনো পাচারকৃত কোন অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারেনি।

গত সেপ্টেম্বর মাসে ১১ টি সংস্কার কমিশন গঠন করলেও এখনো পর্যন্ত মাত্র ৪টি কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দিতে সক্ষম হয়েছে।

খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সাধারণ অধিবেশন ২০২৫ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উপরোক্ত সীমাবদ্ধতাগুলো উত্তরণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ, দ্রত সময়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ২০২৫ এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, ‘বহুত্ববাদ’ কে বাদ দিয়ে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে প্রতিস্থাপন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল ও কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন না করার নিশ্চয়তা সহ সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাকী পরিবর্তনের চেয়েও সেবা এবং নৈতিক মানগত উন্নতি নিশ্চিত করার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

 

প্রস্তাব-৪: ভারতীয় আধিপত্যবাদ প্রসঙ্গ

খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সাধারণ অধিবেশন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অবৈধ সরকারকে টিকে থাকতে সর্বোচ্চ মদদ যুগিয়েছিল বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ডীপ স্টেট।

নিজের ক্ষমতার স্বার্থে ভারতের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতে এমন কোন হীন অপকর্ম নেই যা শেখ হাসিনা ও তার দোসররা করেন নাই। এই খুনী সরকারের পতনের পরও ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একের পর এক তথ্য সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। গুলি চালিয়ে ও জমি দখল করে সীমান্তে উস্কানী দিচ্ছে, আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারি হাই কমিশনে হামলা চালিয়েছে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত সরকার বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। আজকের এই অধিবেশন থেকে আমরা ভারতীয় আধিপত্যবাদী এই নগ্ন আচরণের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি।

ভারতকে বাংলাদেশের উপর আধিপত্যবাদী মানসিকতা পরিহার করে ন্যায্য ও সাম্যতার ভিত্তিতে প্রতিবেশী ও বন্ধুত্বসুলভ আচরণের আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জোর দাবি জানাচ্ছি। ভারতের সাথে বাংলাদেশের ট্রানজিট সহ সকল অসম চুক্তি বাতিলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।


প্রস্তাব-৫: গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা, যুদ্ধবিরতি ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রসঙ্গ

খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সাধারণ অধিবেশন তীব্র ক্ষোভের সাথে লক্ষ্য করেছে যে, অর্ধশতাব্দীরও বেশি কাল ধরে ইহুদীবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনীদের উপর অকথ্য নির্যাতন, গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৮ অক্টোবর ২০২৩ এর পর থেকে বিগত ১৫ মাস ধরে চলা ইসরাইলী আগ্রাসনে ফিলিস্তিনের গাজায় জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ৪৭ হাজারের বেশি মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে। প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষকে মারাত্মক জখম ও পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে।

তবে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থার মতে, ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপাপড়া ও গণকবরের সন্ধানের পর নিহতের সংখ্যা ২ লাখের কাছাকাছি হবে। যাদের দুই তৃতীয়াংশ হচ্ছেন নারী ও শিশু। এর মধ্যে হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে দেশে ও দেশের বাহিরেও টার্গেট করে হত্যা করেছে বর্বর ইসরাইল। হত্যা করা হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশের ইসরাইল বিরোধী মুসলিম নেতৃবৃন্দকেও।

ইতিমধ্যে গাজার ৮৫ ভাগের বেশি বিল্ডিং ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, যা পরিষ্কার করে পুননির্মাণ করতে সময় লাগবে কমপক্ষে ২০ বছর এবং খরচ হবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। আমরা আজকের এই অধিবেশন থেকে ইসরাইলী এসব বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার জানাচ্ছি এবং আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরাইলের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জোর দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি গত ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ থেকে চলমান হামাস-ইসরাইল যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব কামনা করছি। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং গাজা পুনর্গঠনে এগিয়ে আসার জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও রাষ্ট্র সমূহকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
 

মো. মহিউদ্দিন

×