ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১

বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল

সরকার নিরপেক্ষ না থাকলে নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন হবে

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫

সরকার নিরপেক্ষ না থাকলে নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন হবে

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ সরকার নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে নির্বাচন আয়োজন করতে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।  বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। এদিকে বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায়ও বক্তব্য রাখতে গিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। 
বিবিসিকে দেওয়া এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা নতুন রাজনৈতিক গঠন করে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায় বলে জানা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারে নিজেদের প্রতিনিধি রেখে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টি মেনে নেবে না।  
জুলাই-আগস্টের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, আমরা তো চাই আর্লি ইলেকশন। আগেও বলেছি আমরা। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার, যেটা ন্যূনতম সংস্কার, সেগুলো করে যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা।

এটা আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি এবং আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের যে অভিজ্ঞতা দেখেছি আমরা অতীতের কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টগুলোতে, তাতে করে এটা অসম্ভব কিছু না। এটা পসিবল যদি গভর্নমেন্ট চায় যে, ইলেকশন তারা করবে জুন-জুলাইয়ের মধ্যে বা আগস্টের মধ্যে, তারা করতে পারে।
আপনারা  সুনির্দিষ্ট করে বলবেন যে, আপনারা এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন চান? এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, আমরা সুনির্দিষ্ট সময় ওইভাবে বলতে চাই না এ জন্য যে, তাতে তো লাভ হবে না। কারণ গভর্নমেন্টকেও চাইতে হবে। আলাদা পলিটিক্যাল পার্টিদেরও চাইতে হবে, সবাই মিলে একসঙ্গে চাইতে হবে। তবে আমাদের দিক থেকে আমরা মনে করি, এটা কোনো অসম্ভব কিছু না। এটা খুবই সম্ভব এবং যতদ্রুত হয় ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
কিন্তু আপনাদের কোনো ডেডলাইন বা সময়সীমা নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, ডেডলাইন আমরা দেইনি এখনো। পরের প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয় নির্বাচনটা আপনারা যে সময়ের মধ্যে আশা করছেন, যদি দেখা যায় সেটা হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আপনাদের পদক্ষেপটা কী হবে? জবাবে ফখরুল বলেন, সেক্ষেত্রে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। আমাদের পার্টিতে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব এবং আমাদের সঙ্গে যারা আন্দোলনে ছিলেন-আছেন, তাদের সঙ্গেও আমরা আলোচনা করব। আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেব।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন যে, তারা কিছু সংস্কার কাজ করতে চান এবং সেই সংস্কার কাজগুলো শেষ হলে তখন তারা একটা নির্বাচনে যাবেন। তো আপনারা কি অপেক্ষা করতে রাজি আছেন সংস্কার কাজ শেষ করা পর্যন্ত? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা আমাদের কথাগুলো স্পষ্ট করে বলে আসছি।

বলেছি যে, উনি যতগুলো সংস্কারের মধ্যে হাত দিয়েছেন, অতগুলো সংস্কার করতে গেলে আপনার দশ বছরের মধ্যেও শেষ হবে না। আর সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। দু’বছর আগে রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা দিয়েছি আমরা। তার মধ্যে এই বিষয়গুলো তো রয়েছে। সংবিধান সংস্কারের বিষয় রয়েছে, জুডিসিয়াল কমিশনের কথা আমরা বলেছি, আমরা ইলেকশন কমিশনের কথা বলেছি, আমরা ব্যুরোক্রেসি সংস্কারের কথা বলেছি ৩১ দফায়, আমরা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলেছি- এগুলো আমাদের সমস্ত বলা আছে।

এখন সেক্ষেত্রে তারা যেটা করেছেন, সেটা কী রিপোর্ট নিয়ে আসছে আমরা জানি না। যদি রিপোর্টগুলোয় দেখা যায় যে, আমাদের সঙ্গে মিলে গেছে, তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যেগুলো মিলবে না, সেগুলো তো একটা ন্যূনতম কনসেনসাস হতে হবে। তারপরে সেটা হতে হবে।
ফখরুল বলেন, আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আপনি সংস্কার করে দিলেন, কিন্তু সেটাকে অ্যাপ্রুভ করবে কে? তার জন্য তো আইনগত যাদের অধিকার আছে, তারাই করতে পারবে। দ্যাট ইজ পার্লামেন্ট। পার্লামেন্ট ছাড়া কিন্তু কোনো সাংবিধানিক সংস্কার কঠিন হবে। এমনকি অন্যকিছু  বিষয় আছে, যেগুলো আপনার সংবিধানে কিছু কিছু পরিবর্তন আনার দরকার আছে। কিন্তু সেগুলা পার্লামেন্ট ছাড়া সম্ভব নয়। সে জন্যই আমরা মনে করি, দ্য সুনার দ্য ইলেকশন ইজ বেটার।
আপনি কি মনে করেন যে, নির্বাচিত সরকার আসার আগ পর্যন্ত এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাওয়া উচিত হবে না বা তারা যেতে পারে না? এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, যাওয়া উচিত হবে না আমরা বলছি না। কিন্তু যেতে তারা পারবেন না এ জন্য যে, সব দলের কনসেনসাস না হলে কোনোটাই যাওয়া তাদের ঠিক হবে না।
বর্তমান সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, যদি সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা নির্বাচন কনডাক্ট করা পর্যন্ত থাকবেন। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।
আপনার কি ধারণা যে, এই সরকারের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, নিরপেক্ষতার প্রশ্ন আসতে পারে। কেননা, এখানে আমরা জিনিসটা লক্ষ্য করছি যে, আপনার ছাত্ররা তারা একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করার কথা চিন্তা করছেন। সেখানে যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি এই সরকারে থাকে, তাহলে তো নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। ওইটা হচ্ছে, সম্ভাব্য কথা।

কিন্তু যদি তারা মনে করে যে, (সরকারে) থেকেই তারা নির্বাচন করবেন, তাহলে তো রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না। সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে এখন কোনো প্রশ্ন তৈরি হয়েছে? জবাবে ফখরুল বলেন, এখন কোনো প্রশ্ন নেই। আমাদের কাছে কোনো প্রশ্ন নেই।
৫ আগস্টের পর যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা হচ্ছিল, সে আলোচনায় আপনারাও ছিলেন। সেই আলোচনার ভিত্তিতে পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। তখন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদকাল কী হবে, সেটা নিয়ে আপনাদের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি? এর জবাবে ফখরুল বলেন, তখন তো ইলেকশন দ্রুত করার কথাই হয়েছে। দ্রুত ইলেকশন করার কথাই হয়েছে। দ্রুত বলতে কত সময়? কোনো ধারণা, সময়সীমা- এ ধরনের কিছু নিয়ে কথা হয়নি? ফখরুলের জবাব- না, সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। তখন তো সেই সুযোগ ছিল না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর আপনি নিজেই বলেছিলেন যে, এই সরকারকে আপনারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। এখন কি বলবেন? জবাবে ফখরুল বলেন, আমরা সহযোগিতা  করছি। সহযোগিতা অব্যাহত আছে। উনারা যখনই ডাকেন, তখনই আমরা যাই, কথা বলি। না ডাকলে তো যাওয়া যায় না, তার পরও আগ বাড়িয়েও কথা বলি।

আমরা যেগুলো মনে করি যে, এগুলো করা উচিত, সেগুলো তাদের আমরা জানাই। অ্যান্ড উই আর কো-অপারেটিভ। এখন পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে কিন্তু কোনো আন্দোলনও করিনি, কথাও বলি না কোথাও। তবে দু-একটা ভুল-ত্রুটি তো দেখিয়ে দিতেই হয়।
শুরু থেকে আপনাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে সম্পর্কটা ছিল, এখনো কি তাই আছে? নাকি এখানে কোনো দূরত্ব তৈরি হয়েছে? এর জবাবে ফখরুল বলেন,  আমরা মনে করি যে, তাই আছে।
সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রায়ই সময় একটা বিষয় বলা হয় যে, তারা যে সংস্কার কাজগুলো করছেন বা করতে চাচ্ছেন, তার একটা উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ যে ধরনের একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী সরকার তৈরি হয়েছিল, সে ধরনের একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা যাতে বাংলাদেশে আর তৈরি না হয়। আপনার কি মনে হয়, এর দ্বারা আপনাদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়?

এই প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, কোনোমতেই না। কারণ আমরা কখনই স্বৈরতান্ত্রিক ছিলাম না। আমরা সবসময় গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলাম। এখানে মাল্টিপার্টি ডেমোক্রেসি আমরাই নিয়ে আসছি। একদলীয় শাসনব্যবস্থা শেখ মুজিবের, সেখান থেকে ট্রানজিশন টু মাল্টিপার্টি সিস্টেম তো জিয়াউর রহমান সাহেব করেছেন। গণমাধ্যমকে মুক্ত করা, আমরাই করেছি। আপনার পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি তো আমরাই নিয়ে আসছি।

কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট সিস্টেম আমরাই চালু করেছি। আপনি প্রত্যেকটাই দেখেন। সুতরাই প্রশ্নই উঠতে পারে না। আমাদের কেউ স্বৈরাচারী আঙুল তুলবেÑ এ কথা আমরা কখনই মেনে নিতে পারব না। ভবিষ্যতেও এ ধরনের সুযোগ তৈরির প্রশ্নই আসে না। দলটিই তো আমাদের ওই রকম না। আমাদের দলটিই তো গণতান্ত্রিক দল। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। ইউ হ্যাভ অলওয়েজ ট্রাইড টু প্রাকটিস ডেমোক্রেসি।

আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি। ১৫ বছর আমরা লড়াই করলাম এই গণতন্ত্রের জন্য, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। খালেদা জিয়া প্রায় ছয়টা বছর তিনি কারা অন্তরীণ ছিলেন এই মামলার জন্য, এই গণতন্ত্রের জন্য এবং আমাদের তারেক রহমান সাহেব এখনো বিদেশে আছেন। আমাদের প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছে। আমাদের প্রায় সাত শত মানুষ গুম হয়ে গেছে। আমাদের হাজার হাজার লোক খুন হয়েছে- গণতন্ত্রের জন্য। এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার যুদ্ধ করেছিল গণতন্ত্রের জন্য। সুতরাং আমাদের দলে সেই প্রশ্নই উঠতে পারে না। ডেমোক্রেসির চ্যাম্পিয়ন বলতে পারেন আমাদেরকে আপনি।
আপনি সংস্কার কমিশনের কথা বলছিলেন। যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠন হয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি এরই মধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিশন, আপনি এটার কথা বলছিলেন। সেই প্রস্তাবে কয়েকটি বিষয় এসেছে, তার মধ্যে একটি বড় বিষয় যদি বলি যে, মূলনীতি পরিবর্তনের একটি প্রস্তাব আছে। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, বহুত্ববাদ আনার কথা বলা হয়েছে।

এটা নিয়ে আপনার মতামত কী? এর জবাবে ফখরুল বলেন, আমরা এ বিষয়ে এখনই কথা বলব না। আমাদের পার্টিতে একটা কমিটি তৈরি করা হয়েছে। সেই কমিটি অ্যানালিসিস করছে। এটা করার পরে আমাদের বক্তব্যটা আমরা পাবলিকলিই নিয়ে আসব। সেটা কবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দ্রুত, খুব দ্রুত। আর এটা তো খসড়া।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, এই প্রস্তাব তো দিয়েছি আমরাও। সংস্কার প্রস্তাবে যেভাবে দ্বিকক্ষের কথা হলো হয়েছে যে, নি¤œকক্ষ থাকবে নির্বাচনের ভিত্তিতে যেটি হয় এবং উচ্চকক্ষ আনুপাতিক ভোটের হিসেবে। আপনারা এটার সাথে একমত? জবাবে ফখরুল বলেন, না, আমরা সেখানে একমত না। আমাদের ভিন্ন প্রস্তাব আছে, সেটা আমরা আলোচনার মাধ্যমে দেখব।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের বেশকিছু দাবি বিভিন্ন সময় তুলেছিল, যেগুলো আপনারা বিরোধিতা করেছেন বা বাধার মুখে হয়নি। যদি কয়েকটি উদাহরণ দিই, যেমন- রাষ্ট্রপতি অপসারণের কথা, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা এবং সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একটা ইস্যু এসেছে, যেটা আপনারা বিরোধিতা করেছেন।

এ বিষয়গুলোতে আপনাদের আপত্তির কারণ কী? জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আপত্তির কারণ খুব সঙ্গত কারণ। আমরা তো একটা সংবিধানের অধীনে আছি। রাষ্ট্রের যে সংবিধান, সেই সংবিধানের অধীনে আমরা আছি। এই সরকারও শপথ নিয়েছে সেই সংবিধানের অধীনে। সেখানে রাষ্ট্রপতিকে যে অপসারণ করবে, সেটা কে করবে? এটা এক। দুই নম্বর হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি আনবেন কাকে? তিন নম্বর হচ্ছে, এটার লেজিটেমেসি কার হাতে থাকবে?

পার্লামেন্ট নাই। সুতরাং ওই প্রশ্নটাকে আমরা মনে করি যে, অবাস্তব প্রশ্ন। আর যেখানে ওটা কোনো ক্রাইসিস ছিল না। ওই ধরনের কোনো ক্রাইসিস তৈরি হয়নি। সেটা আমরা মনে করেছি, এটা ক্রাইসিস তৈরি করা নতুন করে। আমাদের সামনে এখন একটাই মূল সমস্যা, সেটা হচ্ছে যে, আপনি নির্বাচন অতিদ্রুত করে ফেলা, একটা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দেওয়া। এটা তো আপনার এসেন্স অব ডেমোক্রেসি। এটা গেল এক।

আপনার আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র। এটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও করা হয়নি আগে, আমরা জানিও না এটা। আর (অভ্যুত্থানের) পাঁচ মাস পরে এই ডিক্লারেশনের কোনো যুক্তি আছে কি-না? এটা কি আপনার সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার মতো ব্যাপারটা? যেটা হয়েছেÑ হচ্ছে যে, যাদের অপসারণ করা হয়েছিল ওই সরকারের আমলে, এখন আবার তারা ফেরত পাচ্ছে?

এটা তা না। এটা একটা অভ্যুত্থান, একটা আন্দোলন। সেই আন্দোলনের ডিক্লারেশন তখনই হওয়া উচিত ছিল। এটা ছাত্ররা দিতেই পারে। কিন্তু আমরা ওটার পার্ট তখনই হব, যখন গোটা জাতির প্রশ্নটা আসবে তার মধ্যে, টোটাল জিনিসটা। কোনো আলোচনা না করেই তো আমরা এটা করতে পারি না। প্রশ্নই উঠতে পারে না।
একটা অভ্যুত্থান হয়েছে, একটা বিপ্লব হয়েছে এবং তারা সেখানে নেতৃত্বে ছিলেন। তারা এখন সেটি (ঘোষণা) দিতে চান। এ বিষয়ে আপনাদের মতামত কি? জবাবে ফখরুল বলেন, ছাত্র হিসেবে তারা দিতেই পারেন। জাতি হিসেবে এবং পার্টি হিসেবে তো আমরা সেটার মধ্যে থাকতে পারি না। আমাদের ন্যারেটিভ আছে। ১৫ বছর আমরা লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি।

আমাদের এসব বিষয়গুলো এখানে থাকবে। এর আগে, সাতই নভেম্বরের বিষয়গুলো সেখানে আসতে হবে, নব্বইয়ের গণআন্দোলন সেখানে থাকতে হবেÑ এগুলো তো থাকতে হবে। আর একাত্তর হচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব, মুক্তিযুদ্ধ। সেই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে চব্বিশকে একমাত্র গুরুত্ব দেওয়ার কথা আসতে পারে না।
আপনি বলছিলেন যে, একাত্তরের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এ বিয়টি বলবেন? জবাবে ফখরুল বলেন,  আমি এর আগেও বলেছি। আমার কাছে কেন জানি মনে হয় যে, একটা পক্ষ একাত্তরকে একটু পেছনে রাখতে চায়। এরপর প্রশ্ন করা কারা? জবাবে তিনি বলেন, আছে কিছু হয়তো। তারা চেষ্টা করছেন। এটা আমার মনে হচ্ছে। আমি এক্সাক্টলি আপনাকে ঠিক বলব না, বলতে পারব না।

কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, একাত্তরকে পেছনে ফেলার একটা চিন্তাভাবনা কারো কারোর মধ্যে থাকতে পারে। আবারও প্রশ্ন করা হয়- এতে কী সুবিধা হবে, একাত্তরকে যদি পেছনে ফেলা হয়? জবাবে ফখরুল বলেন, যাদের সুবিধা হবে, সেটা আপনারা জানেন সবাই। আমি রিপিট করেতে চাই না।
জুলাই অভ্যুত্থানের বিষয়ে বলি। যখন নির্বাচনে কথা আসে, তখন ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে যে, নির্বাচনের জন্য জুলাই অভ্যুত্থান হয়নি। আপনাদের নির্বাচনের দাবির বিপরীতে জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটের কথাও প্রায় সময় বলা হয়। তো এই বিষয়টিকে আপনারা কীভাবে দেখেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, আমাদের খুব পরিষ্কার করে বলা আছে, ভাই। আমরা আন্দোলন করছি, রাজনৈতিক দল করছি, দেশে একটা ডেমোক্র্যাটিক সেটআপের জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।

আর গণতন্ত্রে ঢোকার প্রথম ধাপটিই হচ্ছে, নির্বাচন। যেহেতু তিন তিনটি নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকার নষ্ট করে দিয়েছে, জনগণ ভোট দিতে পারেনি। আমার ভোটের অধিকারটা তো প্রথম অধিকার নাগরিক হিসেবে। আমি এই দেশের মালিক। আমার একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে, আমার ভোটটা। সেটাই তো আমরা দিতে পারিনি। সুতরাং নির্বাচন চায় না বা নির্বাচন প্রধান নয়- এ কথা চিন্তা করাও তো ভুল। নির্বাচনটা আমরা মনে করি প্রধান।

কারণ এই নির্বাচনের মাধ্যমেই আমি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারব। আমি গণতান্ত্রিক সংবিধানের পরিবর্তনগুলো আনতে পারব। গণতান্ত্রিক একটা রাষ্ট্র আবার পুনর্নির্মাণ করতে পারব। এ ছাড়া আমার বিকল্প কিছু নেই।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে আপনাদের একটা দ্বিমত দেখা গেছে? জবাবে ফখরুল বলেন,  না, এটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। মিডিয়া এটাকে একুট ভুলভাবে প্রচার করছে। কোন জায়গাটায় ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে? এর জবাবে ফখরুল বলেন, আমরা কিন্তু পরিষ্কারভাবে বলেছি যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারটা পুরোপুরি জনগণের ব্যাপার। জনগণ যদি চায় যে, তারা কোনো দলকে নিষিদ্ধ করবে, তাহলে তারা করতেই পারে।

সেটা কীভাবে হবে? সেটা পার্লামেন্টে হতে পারে বা অন্য কোনো মাধ্যমে হতে পারে। কিন্তু কীভাবে আপনি জানবেন যে, জনগণ চাইছে কি চাইছে না? এর জবাবে ফখরুল বলেন, ভোটের মাধ্যমে সেটা জানা যাবে। ইলেকশনের মাধ্যমেই সেটা জানা যাবে। আমি একটা পলিটিক্যাল পার্টি। আমি তো আরেকটা পলিটিক্যাল পার্টিকে নীতিগতভাবে, জামায়াতে ইসলামীকে যখন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, আমরা প্রতিবাদ করেছি।

আমরা নীতিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক দলকে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে রাজনীতি করে, তাদের নিষিদ্ধ করার ব্যাপারটাতে আমরা কখনোই একমত হইনি। এটা আমরা বলেছি যে, জনগণ ডিসাইড করবে যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে- কি হবে না। এটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে অনেক আমি জানি। কিন্তু এই বিতর্কের কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না।
আপনি বলছিলেন ভোটের মাধ্যমে সেটা জানা যাবে। তো আগামী নির্বাচনে কি তাহলে আওয়ামী লীগ...? জবাবে ফখরুল বলেন, সেটা আওয়ামী লীগ আসতে পারলে আসবে, না আসতে পারলে আসবে না। দ্যাটস নট মাই পয়েন্ট। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো কথা নেই। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, কোন দল নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, সেটা তো দলগুলো নিজেরাই ঠিক করবে।

তখনকার সেটআপ ঠিক করবে, ইলেকশন কমিশন ঠিক করবে। আমরা কথাটা খুব পরিষ্কার করেই বলছি যে, আমরা মনে করি কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব আমাদের না। আমরা চাই যে, জনগণের মাধ্যমে সবকিছু নির্ধারিত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারছে নাÑ ফখরুল ॥ অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারছে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে শহীদ আসাদের ৫৬তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। শহীদ আসাদ পরিষদ এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
ফখরুল বলেন, আমি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছি, অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিরপেক্ষ না থাকে, নির্বাচনের সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকার দরকার আছে, আমি এই কথাটা বলেছি এই কারণে যে, আমরা দেখছি কিছু বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তাই অনুরোধ করব, প্রত্যাশা করবো, আমরা আশা করি এ সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। দেশে যে সংকট আছে সে সংকট থেকে মুক্ত করার জন্য দায়িত্ব পালন করবে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচন থেকে আমরা প্রায় ১৫ বছর বঞ্চিত। এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের জনগণ তাদের একজন প্রতিনিধি নিয়োগ করার একটা সুযোগ পাবেন। এখন জোর করে যদি বিষয়টাকে বিতর্কিত করে ফেলা হয় তাহলে জনগণ আবার তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের  ভোট হবে ব্যালটে একজন নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যের জবাবে ফখরুল বলেন, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এ ধরনের নির্বাচন যদি দ্রুত না করা হয়, সময়ক্ষেপণ করা হয়, তাহলে সেখানে অন্যান্য শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। তারপর জনগণের যে চাহিদা, সেই চাহিদা থেকে পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত হয়।
ফখরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। স্বাভাবিকভাবেই একটি গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকজনক হলেও সত্য, এখন পর্যন্ত যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে সেখানে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না যে বেশি প্রত্যাশা পূরণ হবে।

এখানে অনেক কথা আছে, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন রকমের প্রোগ্রাম আছে, কর্মসূচি আছে, সে কর্মসূচিগুলোতে সবাই একটা জায়গায় একমত, একটা নির্বাচন হওয়া দরকার। নির্বাচন শুধু একটি দলকে ক্ষমতায় পাঠানোর জন্য না, নির্বাচনটি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যাওয়ার জন্য একটি পথ সৃষ্টি করা।আজ সবগুলো সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্ন উঠেছে। তাহলে কি আমরা ৪/৫ বছর ধরে অপেক্ষা করব? যতদিন সম্পূর্ণ সংস্কার না হবে ততদিন ধরে অপেক্ষা করবে জনগণ? তারা তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
ফখরুল বলেন, আমরা এখনো দেখছি যে আমলাতন্ত্র আগে যে অবস্থায় ছিল, এখনো সচিবালয় থেকে শুরু করে সমস্ত প্রশাসনে একইভাবে তাদের ভূমিকা পালন করছে। কোনো রদবদল হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া একদম বন্ধ হয়ে গেছে, স্কুল-কলেজগুলোতে সেভাবে লেখাপড়া হচ্ছে না। স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। এগুলো অতীত থেকেই এসেছে।

সেগুলো পরিবর্তন এত অল্প সময়ে সম্ভবও নয়। সে জন্যই আমরা বলছি, নির্বাচন দ্রুত হওয়া দরকার। নির্বাচন দ্রুত হলে যে সরকার আসবে, রাজনৈতিক কমিটমেন্ট যেগুলো থাকবে সে কমিটমেন্টগুলো পালন করার জন্য অবশ্যই দায়বদ্ধ থাকবে।
অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর সভাপতিত্বে ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের সদস্য সচিব হাবিবুর রহমান রিজুর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, জহির উদ্দিন স্বপন, দলের যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, শহীদ আসাদের ভাই আজিজুল্লাহ এম. নুরুজ্জামান নূর প্রমুখ।

×