ছবি: সংগৃহীত।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতার স্থাপন নিয়ে বিতর্ক, বিরোধ এবং ইতিহাস বহু পুরনো। ৪,০৯৬ কিলোমিটারের এই বিশাল সীমান্তে কাঁটাতার বসানোর প্রকল্প প্রথম আলোচনায় আসে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। তখন বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ভারতের আসামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী দাবি তুলেছিল অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে দেওয়াল বা কাঁটাতার বসানো হোক। তবে সেই দাবি তখন কার্যকর হয়নি।
১৯৮৫ সালে আসাম শান্তিচুক্তির পর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত সুরক্ষার উদ্দেশ্যে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সীমান্তে বেআইনি পারাপার ও অনুপ্রবেশ রোধে আন্তর্জাতিক সীমান্তে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যেই ভারতের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের সঙ্গে কাঁটাতার বসানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। পূর্ব সীমান্তেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করার পেছনে চোরাচালান ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঠেকানোর কারণ দেখানো হয়।
বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতার বসানোর প্রকল্প শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। প্রথম ধাপে ৮৫৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বেড়া বসানো হয়, যা মোট সীমান্তের মাত্র ২০ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু হয় ২০০০ সালে। এ সময় আরও ২,৪৩০ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তবে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কাজের অর্ধেকও সম্পন্ন হয়নি।
প্রায় চার দশকের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এখনো পর্যন্ত ভারত পুরো সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসাতে পারেনি। বর্তমানে মোট সীমান্তের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকায় কাঁটাতার স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। কিছু জায়গায় কাজ বিভিন্ন কারণে থমকে আছে।
সীমান্তে কাঁটাতার বসানো নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বরাবরই উত্তেজনা বিদ্যমান। সীমান্তবাসী মানুষদের জীবনে এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে। কাঁটাতার বসানোর ফলে সীমান্তের একপাশ থেকে অন্যপাশে সহজ যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যা সীমান্তের মানুষের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
২০১১ সালে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানি খাতুনের মৃত্যু ও কাঁটাতারে ঝুলন্ত তার লাশের ছবি ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ক্ষোভের প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতের মধ্যেও কাঁটাতার প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল।
বাংলাদেশ সরকার কখনো কাঁটাতারের প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে বাধা দেয়নি, আবার এর প্রতি উৎসাহও দেখায়নি। জেনারেল এরশাদ, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার বিভিন্ন শাসনামলে ঢাকার অবস্থান প্রায় একই ছিল। তবে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের সময় সীমান্তের জিরো লাইন থেকে ১৫০ গজের মধ্যে ভারতের স্থাপনা নির্মাণে কিছু এলাকায় অনুমতি দেওয়া হয়। এর ফলে ভারতের পক্ষে কাঁটাতারের কাজ সহজ হয়।
সম্প্রতি সীমান্তে নতুন করে কাঁটাতার বসানোর চেষ্টা ঘিরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্তের উভয় পাশে মানুষজন মারমুখী হয়ে উঠছেন। দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরা বাঙ্কার ও পরিখা খুঁড়ছে। ঢাকা ও দিল্লিতে রাষ্ট্রদূতদের তলব করা হচ্ছে।
ভারত দাবি করে কাঁটাতার বসানো চোরাচালান, অনুপ্রবেশ এবং সন্ত্রাস রোধে কার্যকর। কিন্তু সীমান্তের দুই পাশের মানুষজনের জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব অনস্বীকার্য। উভয় দেশের জন্য এটি কেবল একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নয়, বরং কূটনৈতিক ও মানবিক সম্পর্কের একটি জটিল অধ্যায়।
সীমান্তে কাঁটাতার বসানো কি সত্যিই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে, নাকি এটি দুই দেশের মানুষের মধ্যে আরও বিভাজন তৈরি করবে—এই প্রশ্ন আজও উন্মুক্ত।
সূত্র: বিবিসি।
সায়মা ইসলাম