ছবি : সংগৃহীত
‘গতকাল এনসিটিভি কার্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করা হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক, আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’ বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারী) সকাল ৯টায় রাজধানীর মগবাজরস্থ আলফালাহ মিলনায়তনে দুদিনব্যাপী চলা কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের প্রথম সাধারণ অধিবেশনে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম এই মন্তব্য করেন।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, “আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, একটি মহল, একটি ফ্যাসিবাদী, নতুন ফ্যাসিবাদী শক্তি, তারা বিভিন্ন বিষয়ে, বিভিন্ন ঘটনায়, কোন ধরনের সত্যতা যাচাই না করেই ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপর তাদের নিজেদের অপকর্মের দায় চাপিয়ে দিচ্ছে। এর প্রতিবাদ জানানোর কোন ভাষা আমাদের জানা নেই। এসব মিথ্যাচার বন্ধ না করলে, আমরা তাদের বিষয়ে দ্রুত সময়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।
সম্প্রতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কোরআন পোড়ানোর ঘটনা আমরা লক্ষ্য করেছি। এটি খুবই দুঃখজনক, বাংলাদেশের মত একটি রাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা কখনো আমাদের কাম্য নয়। অবিলম্বে সকল ঘটনাগুলোর দায়ীদেরকে চিহ্নিত করে, তাদেরকে আইনে আওতায় নিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।
আমাদের পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের সম্পদ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একটি মহল এই পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে নানা ধরনের অপতৎপরতা এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তাদের এই সকল অপতৎপরতা বন্ধে সরকারকে জোরালো ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান করছি।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের শাসন আমলে দীর্ঘ ১৬ বছর বাংলাদেশের মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দুর্নীতি, অর্থপাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে করেছে পঙ্গু। দেশের মানুষকে নানাভাবে দ্বিধাবিভক্ত করে, জাতীয় ঐক্য এবং সংহতিকে দুর্বল করার নানামুখী অপতৎপরতা তারা চালিয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে গুম, খুন, নির্যাতনের স্টিম রোলাম চালিয়েছে। মুক্তিকামী জনতার উপর, বিশেষত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উপর অবর্ণনীয় অমানবিক দমন-নিপীড়ন চালিয়েছে। অবশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো আবাবিল রূপে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, ফ্যাসিস্ট হাসিনা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু দেড় হাজার ছাত্রজনতার, দেড় হাজারেরও বেশি ছাত্রজনতার রক্ত, জীবন এবং হাজার হাজার মানুষের আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে যে মুক্তি এসেছে, আমরা এই ঋণের দায়ে আবদ্ধ।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পাঁচ মাস অতিক্রান্ত হলেও, বাংলাদেশের প্রশাসন এখনো পুরোপুরি ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়নি। বরং ফ্যাসিবাদের দোসররা নানাভাবে বাংলাদেশকে অশান্ত, অকার্যকর, অস্থিতিশীল করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রজনতার উপর যারা গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের সিংহভাগ এখনো পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি।
আমরা এটাও লক্ষ্য করছি, যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, অথবা যাদের বিচার শুরু হয়েছে, মামলা বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদের মধ্য থেকে অনেকেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। অনেক অপরাধী নির্বিঘ্নে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। অনলাইন, অফলাইনে আমরা খুনিদের কোন ধরনের অনুশোচনা তো দেখিনি বরং তারা এই খুন এবং এই গণহত্যা নিয়ে আস্ফালন চালাচ্ছে। আওয়ামী লুটের সময় দেশের মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা তারা এদেশ থেকে পাচার করেছে, তা উদ্ধারের জন্য সরকারের উদ্যোগ এখন অপর্যাপ্ত বলে আমরা মনে করি।
বরং সেই লুট এবং পাচারকৃত অর্থ দিয়ে তারা বাংলাদেশকে অশান্ত করার জন্য ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে অনেক আহত বীর এখনো পর্যন্ত শহীদ হচ্ছেন, অনেকে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, কিন্তু তাদের সুচিকিৎসার জন্য উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলে আমরা মনে করছি। একদিকে আমরা শহীদদের দাফন করছি, অন্যদিকে খুনিরা আজও মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেটা কখনোই ছাত্রজনতার কাম্য নয়, আমরা এটা দেখতে চাই না।
মানুষ একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে জুলাই ছাত্র অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল কিন্তু ছাত্রজনতার আকাঙ্ক্ষিত যে পরিবর্তন হওয়ার কথা রাষ্ট্রের কাঙ্খিত সংস্কারসমূহ এখনো সেভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। এই কার্যক্রম আমরা খুবই ধীর লক্ষ্য করছি।
আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি, ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের স্পিড ছিল ঐক্য এবং শাহাদাতের তামান্না।
ঐক্যের স্পিরিটের পেশা, বিভিন্ন দলমত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর ছাত্রজনতা, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল।
শাহাদাতের তামান্না তাদেরকে গণহত্যার মুখেও, শত শত জীবনের মুখেও, তাদেরকে পিছপা হতে দেয়নি। এজন্য আমরা মনে করি, এই অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে বিনষ্ট করার অপচেষ্টা যারা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য জন্য ছাত্রজনতার ঐক্য এবং শাহাদাতের তামান্নাকে পুনরুজ্জীবন করা প্রয়োজন।
আমরা ছাত্রজনতার উদ্দেশ্যে বলতে চাই, শহীদ-গাজীদের আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন যদি আমরা নিয়ে আসতে চাই, তাহলে ছাত্রজনতার স্পিরিটকে আমাদেরকে ধারণ করতে হবে এবং সেটাকে সমুন্নত রাখতে হবে। এই দুটো স্পিরিটকে যদি আমরা সমুন্নত রাখতে পারি, তাহলে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের স্বপ্ন, শহীদ-গাজীদের যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। অন্যথায়, এ স্বপ্ন অধরায় থেকে যাবে।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির শুরু থেকে ঐক্যকে ধারণ এবং বিকাশিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। আগামী দিনেও আমরা আমাদের ঐক্য এবং এই দৃঢ়তার ভূমিকা পালন করে যাব ইনশাআল্লাহ।”
তিনি আরও বলেন, “কথিত স্বৈরাচারের সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষাখাত। তারা বাংলাদেশে মেরুদণ্ডহীন একটি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এ সমাজ, এ রাষ্ট্রকে পরিচালনা করেছে। কিন্তু অভ্যুত্থান পরবর্তীতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কাজটি যেভাবে করে হওয়া প্রয়োজন ছিল, সেরকম কোন উদ্যোগ আমরা দেখছি না। আমরা আজকের এই অধিবেশন থেকে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে সৎ, যোগ্য, দক্ষ এবং অভিজ্ঞদের নিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠন এবং নৈতিকতা ও আধুনিকতার সমন্বয়ে একটি যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সৎ, দক্ষ এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে, তাদেরকে দেশের সম্পদে পরিণত করতে হবে।
আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে আবাসন সংকট প্রকট। সম্প্রতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হলের দাবিতে আমরণ কর্মসূচি পালন করেছে। চলমান ছাত্র আন্দোলনে আমরা সংহতি জানাচ্ছি এবং শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে অবিলম্বে এ সমস্যার শিক্ষার্থীবান্ধব সমাধান নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। সেই সাথে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক হল নির্মাণ করে, শতভাগ শিক্ষার্থীকে সিঙ্গেল আসন বরাদ্দ দেওয়া এবং হলে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতের উদ্যোগ নেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের আত্মার পরিবর্তন, চিন্তার পরিবর্তন, সেজন্য ধর্মীয় শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ, আরবি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিসহ, থিওলজির বিভাগগুলো চালু করার জন্য সরকারের প্রতি বিশেষভাবে আহ্বান জানাচ্ছি।
আওয়ামী লীগের ইসলাম বিদ্বেষী শাসন আমলে বাংলাদেশের মাদ্রাসাসমূহ অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখনো দেশের মাত্র তিনটি মাদ্রাসা সরকারি, আর অল্প কিছু মাদ্রাসায় অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করলেও, মাদ্রাসায় ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ চালু নেই। মাদ্রাসাসমূহে অনার্স মাস্টার্সের সুযোগ বিস্তৃতীকরণ, পাশাপাশি আলিয়া ও কওমিসহ সকল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী যেন পড়াশোনা শেষ করে, তাদের সম্মানজনক কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে, সরকারকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের ক্যাম্পাস গুলোতে বিগত তিন দশক ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। অথচ শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠ পরিবেশ বজায় রাখা, শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, এই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। এখন পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ নিয়েছে। অবিলম্বে সকল ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘ আড়াই দশকে গণতন্ত্রহীনতার যে চর্চা, সেই পরিস্থিতির অবসান ঘটবে বলে আমরা মনে করছি।”
মো. মহিউদ্দিন