গণভবনে ৪ আগস্টের রাত্রে ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ও ভয়ঙ্কর এই রাতে নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক দফা বৈঠক করেন । তিনি বৈঠক করেন মন্ত্রী দলের শীর্ষ নেতা ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠকের রাগারাগি
ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় রাত ১২টা থেকে থেকে সোয়া বারো টার দিকে তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত তারেক সিদ্দিকী সে বৈঠকে পদত্যাগের বিষয়টি উঠানো হলে
প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে বলতে থাকেন যা হবার হবে তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না । শেখ হাসিনা সেনাপ্রধানকে মেরুদণ্ড শক্ত করে কঠোর হয়ে বিক্ষোপ দমনের নির্দেশ দেন । জেনারেল তারেক সিদ্দিকী শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়ে বলতে থাকেন সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কিছু লোককে মেরে ফেললেই
বিক্ষোপ এমনিতেই দমন হয়ে যাবে। বিমান বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর কথাও তিনি বলেন এমন পরিস্থিতিতে বৈঠকে উপস্থিত বিমান বাহিনীর প্রধান তারেক সিদ্দিকীর উপর ভীষণ রেগে যান এবং প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন এই লোকটি আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরো ডোবাবে ঠিক এসময় একজন অপরিচিত ব্যক্তি যাকে ডিউটিরত এসএসএফ সদস্যরা চেনেন না গণভবনে প্রবেশ করলে শেখ হাসিনা সভা শেষ করে দেন । রাত ১২:৪০মিনিটে তিন বাহিনী প্রধান গণভবন ত্যাগ করেন। রাতে গণভবনে পুলিশের আইজি আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং এয়ার ভাইস মার্শাল অবসরপ্রাপ্ত জামাল উদ্দিনও ছিলেন ৫ আগস্ট সকাল ৯টায় বাহিনীর প্রধান আবার গণভবনে আসেন এসময় পুলিশের আইজি এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুবুর রহমানও গণভবনে ছিলেন বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পুলিশের আইজি আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দেখিয়ে বলেন ওরা ভালো কাজ করছে সেনাবাহিনী পারবে না কেন এসময় পুলিশের আইজি বলেন পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে তাতে পুলিশের পক্ষেও আর বেশি কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হবে না কারণ আমাদের আর কিছু করার সামর্থ্য নেই অস্ত্র গোলাবারুদ আর অবশিষ্ট নেই ফোর্সও টায়ার্ড হয়ে পড়েছে। সামরিক কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে আবারো ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেন এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী রেগে গিয়ে বলেন তাহলে তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো এবং গণভবনে কবর দিয়ে দাও সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে রাজি করাতে অনুরোধ করেন তারা একথা বলেন যে সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের ডাকে লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির কারণে গণভবন অভিমুখে ঢাকার চারপাশ থেকে মিছিল আসছে এ পর্যায়ে শেখ রেহানা প্রধানমন্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা চালান এক পর্যায়ে বড় বোন শেখ হাসিনার পা জড়িয়ে ধরেন তিনি কিন্তু শেখ হাসিনা রাজি হচ্ছিলেন না। পরে জয়ের সঙ্গে কথা বলেন। শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা জয়কে বলা হয় প্রাণে বাঁচাতে হলে তার মাকে পদত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই । টাইম একটি ফ্যাক্টর এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে জয় পরিস্থিতি জানার পর মায়ের সঙ্গে কথা বলেন অবশেষে জয়ের কথায় ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
শেখ হাসিনা তিনি টেলিভিশনে প্রচারেরজন্য একটি ভাষণ রেকর্ড করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সামরিক কর্মকর্তারা অপারগতা প্রকাশ করেন এসময় তারা প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাগ গোছাতে ৪৫মিনিট সময় বেঁধে দেন কারণ গণভবন অভিমুখে লাখ লাখ ছাত্রজনতা যে মিছিল আসছে সে সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে। ছাত্রজনতার এই স্রোত ছিল ৩৬ দিনের অভাবনীয় আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ ২৪ এর বিপ্লব ছাত্র গণঅভ্যুত্থান সেনাবাহিনী ছাত্রজনতার উপর গুলিবর্ষণ করবে না । ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান একথা জানিয়ে দেয়ার পরেই মূলত শেখ হাসিনার রাজত্বের বিদায় ঘন্টা বেজে যায় । ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশব্যাপী সেনামোতায়ন ছিল। আন্দোলন পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও ফিডব্যাক নিতে ওইদিন সেনা সদরে বিভিন্ন স্তরের সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারুজ্জামান মতবিনিময় করেন দেশের অন্যান্য ফরমেশনের কর্মকর্তারাও ভার্চুয়ালি ওই সভায় যোগ দেন শুরুতে আধা ঘন্টার একটা উদ্বোধনী বক্তৃতা করেন । সেনাপ্রধান তিনি সরকারের নির্দেশনায় সিভিল প্রশাসনের সহায়তায় কেন সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে তা ব্যাখ্যা করেন সভায় তিনি একথাও বলেন আমাদের দেশে ১৯৭০সালের পর এমন গণবিক্ষোপ আর কখনো হয়নি তাই আমাদের এই পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে
মোকাবেলা করতে হবে। সেনাপ্রধানের বক্তব্যে এর পর উপস্থিত কর্মকর্তাদের বক্তব্য আহ্বান করা হয় বক্তব্যের জন্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং এর চেয়ে ঊর্ধ্বতনু কয়েকজন কর্মকর্তা হাত তুললেও সেনাপ্রধান তরুণ কর্মকর্তাদের কথা শুনতে চান সভায় সেদিন ছয় থেকে সাতজন সেনা কর্মকর্তা নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতা শোনান রাজশাহীর একজন নারী সেনা কর্মকর্তা বাংলায় আবেগপূর্ণ ভাষণে বলেন দেশের সব মাকে মৃত্যু স্পর্শ করেছে এবং সব মা কাঁদছেন তিনি মীরমুগ্ধর প্রতিবেশী ছিলেন যে মুগ্ধ ঢাকার উত্তরায় ছাত্রদের মিছিলে পানি বিতরণ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন নারী কর্মকর্তা মেজর হাজেরা জাহান এ ঘটনায় শিশুদের প্রাণহানি ও এর ন্যাজ্য বিচার হওয়ার উপর গুরুত্ব দেন তিনি সেনাবাহিনীর উপর অসন্তোষ বাড়তে থাকা নিয়েও উদ্বেগের কথা জানান সেনাপ্রধান তার মনোভাবের সঙ্গে একমত হন ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি গুলির ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন ক্যাপ্টেন বর্ণনা করেন সেদিন কিভাবে কর্তব্যরত সেনা সদস্যদের জনতা ঘিরে ধরেছিল এবং তিনি পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি সেনাবাহিনীর উপর জনগণের সমর্থন কমে যাওয়ার কথা তুলে ধরে সেনা সদস্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেন পাঁচ এয়ার ডিফেন্স রেজিমেন্ট কমান্ডিং অফিসার লেফটেনেন্ট কর্নেল মাহবুব এ ধরনের বেশ কিছু বক্তব্য সভায় আসে সেনাপ্রধান কর্মকর্তাদের বক্তব্য শোনার পর সিদ্ধান্ত দেন যেকোনো উস্কানিতেও সেনাবাহিনী ছাত্রজনতার উপর গুলিবর্ষণ করবে না ।
ছাত্রদের মিছিলকে প্রতিহত কিংবা বাধা দেবে না মিছিল চলাকালে সেনা সদস্যরা বরং সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দেবে সেনাপ্রধান সভার এই সিদ্ধান্ত প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জানিয়ে দেন । এ সিদ্ধান্তে শেখ হাসিনা সেনাপ্রধানের উপর ক্ষুব্ধ হন ৪ আগস্ট ডাউন ক্লাবে অনুষ্ঠিত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠকটিও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । ওই বৈঠকে সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল নুরুদ্দিন সহ কয়েকজন সাবেক সেনাপ্রধান উপস্থিত ছিলেন তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে সেদিন মিছিলও করেছিলেন।
৪ আগস্ট দুপুরে গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতার বার্তা শেখ হাসিনাকে পৌঁছে দেন তার কে অনুরোধ করেন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে পদত্যাগ করার সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাকে শিরিন শারমিন চৌধুরী একথা জানান তিনি এও জানান তার পরামর্শ ও প্রবীণ নেতাদের বার্তায় শেখ হাসিনা পদত্যাগে রাজি হয়েছিলেন কিন্তু গণভবনে তখন উপস্থিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত এর তীব্র বিরোধিতা করেন রাতে গ্যাং অফ ফোর নামে পরিচিত ওবায়দুল কাদের আনিসুল হক সালমান ইফ রহমান ও আসাদুজ্জামান খান কামাল শেখ হাসিনাকে কঠোর অবস্থানে নিয়ে যান। তারা হাসিনাকে বলেন এখন কোনভাবেই নরম হওয়া যাবে না নতি স্বীকার করা যাবে না ।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে ৪ আগস্ট বাংলাদেশ টেলিভিশনের ডিজি কে ফোন করে জানানো হয় শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দুপুর ১২টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন ৪ আগস্ট রাতে ভাষণ রেকর্ড করার জন্য গণভবনে বিটিভির ওভি ভ্যান টিম পাঠানো হয় । ৫ আগস্ট সকালে বিটিভির স্ক্রলেও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারের কথা দেখানো হয় কিন্তু ৫ আগস্ট বেলা ১১টায় আইএসপিআর থেকে বিটিভির মহাপরিচালককে জানানো হয় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারুজ্জামান বেলা ২টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন । আইএসপিআর থেকে ওভি ভ্যান চাওয়া হলে বিটিভি থেকে বলা হয় ওভি ভ্যান গণভবনে রয়েছে সেখান থেকে নেয়া সহজ হবে । সেনাপ্রধানের সেই ভাষণ প্রচার করা হয়েছিল বিকেল চার টায় বঙ্গভবন সূত্রে জানা গেছে ৪ আগস্ট শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি মোঃম্মদ শাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে ফোন করে জানান দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে তিনি যেন তৈরি থাকেন। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি সেক্রেটারি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারিকে ফোন করে জানান প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময় বঙ্গভবনে আসতে পারে।
রাজু