বিএনপির লোগো
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) শুরু থেকেই সমর্থন ও আস্থা প্রকাশ করে এলেও নির্বাচনের সুস্পষ্ট সময়সীমা নিয়ে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় এখন প্রতিনিয়ত অসন্তোষ জানাচ্ছেন দলটির নেতারা।
রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদের মুখে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করেন। কিন্তু তাতে অস্পষ্টতার অভিযোগ তুলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন দলটির মহাসচিব।
এর আগেও উপদেষ্টাদের কারো কারো বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে দলটিকে। উপদেষ্টাদের সেসব বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে যে ভাষ্য প্রকাশ পেয়েছিল তাতে বিএনপি'র প্রতিই ইঙ্গিত ছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে সব কথা মূলত নির্বাচন ও সংস্কারকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। নির্বাচন নাকি সংস্কার, কোনটি অগ্রাধিকার পাবে এই প্রশ্নেই বিভক্ত রাজনৈতিক শক্তিগুলো।
বিএনপি ন্যূনতম জরুরি সংস্কার করে নির্বাচনের পক্ষে আর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা, জামায়াত এবং বেশকিছু রাজনৈতিক দল সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষপাতী।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘ডেমোক্রেটিক অর্ডারে দেশটাকে ফিরিয়ে নেওয়া এক নাম্বার প্রায়োরিটি। ১৬ বছর ধরে মানুষ রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, দেশের ওপর তার মালিকানা ফিরে পাবার জন্য। যারা সেটা অনুধাবন করতে পারবেন না সেটা তাদের সমস্যা, আমাদের সমস্যা নয়।’
বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘এখনো আশা করি আমাদের মতামত আমলে নিয়ে তারা সঠিকভাবে দেশটা পরিচালনা করবে এবং সামনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে থাকা কোনো পক্ষের সাথেই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় ধরনের কোনো মতভেদ হয়েছে, এমনটা তারা অনুভব করেন না। রাষ্ট্র সংস্কার, নির্বাচন, বিচার এগুলো জটিল প্রক্রিয়া। এসব ক্ষেত্রে মতভিন্নতার মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটা কমিশন গঠন করা হচ্ছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক তারানা বেগমের মতে, সরকার কৌশলী হয়ে নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সময় কমতে কিংবা বাড়তেও পারে বলে যেসব ধারণা দিচ্ছে, সেগুলোই ধোঁয়াশা ও সংশয় বাড়াচ্ছে।
আরেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের সময়সীমা একরকম স্পষ্টই করা হয়েছে। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে এর অন্যথা হওয়ার কথা নয়।
এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য কি সরকারের প্রতি তাদের মনোভাব পরিবর্তনের আভাস নাকি এর অন্য কোনো রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে?
আস্থা ও সমর্থন প্রসঙ্গ:
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করে যার মধ্যে রয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। তাদের প্রতিবেদন আসার আগেই পুরনো আইনের অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।
প্রধান উপদেষ্টা সম্ভাব্য সময়সীমা জানানোর পর তার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, এবার দিনক্ষণ অর্থাৎ তফসিল ঘোষণার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সরকারের কাজ তাদের সহায়তা দিয়ে যাওয়া।
তারপরও বিএনপি নেতাদের তরফে সময়সীমা নিয়ে তাগিদ দেওয়া কমেনি। তাহলে কি সরকারের প্রতি দলটির 'আস্থা' ও 'সমর্থন' এর মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে?
বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এখন দেশের অগ্রাধিকার। সেদিক থেকে মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি। তবে দেশের জনগণের মধ্যে যেহেতু নির্বাচন নিয়ে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করতেছে তাই আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে এটা পরিষ্কার করার কথা বলছি।’
বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সবসময়ে যে সব বিষয়ে প্রশংসা করতে হবে এমন নয়। সমালোচনা বেশি করে ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে আসলে সরকারকে সহযোগিতাই করা হয় অন্যভাবে যদি চিন্তা করেন।
বিএনপি নেতাদের বক্তব্যকে তাদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ বলে মনে করেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তার মতে, রাজনৈতিক কৌশল এক জিনিস আর রাজনৈতিক পরিকল্পনা অন্য জিনিস। এখন বিএনপি হয়তো রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এগুলো বলছে। কিন্তু আমরা কখনো ফিল করি না যে বিএনপি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল যারা আন্দোলনের পক্ষে ছিল তাদের সাথে বড় ধরনের কোনো মতভেদ হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আস্থার সংকট হলে চিন্তিত হওয়ার ব্যাপার থাকে। কিন্তু আস্থার সংকট হয়েছে বলে মনে করি না।’
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘এই কমিশনের আলোচনার মধ্য দিয়ে যেকোনো বিষয়ে মতভিন্নতা থাকলেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবো এটা আমরা মনে করি।’
বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল:
বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বেশ কয়েকবার 'সংস্কারের প্রয়োজনে যদি'র উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। সরকারের তরফে সংস্কারের শর্তসাপেক্ষে নির্বাচনের সময়সীমা উল্লেখ করায় বিএনপি'র মধ্যে উদ্বেগ কাটেনি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক তারানা বেগম। বলেন, ‘সরকার যে কৌশলী হয়ে বলছে বাড়তেও পারে কমতেও পারে, এগুলোই ধোঁয়াশা ও সংশয় বাড়াচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে কী হতে পারে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোও তেমন ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। তাই, স্বচ্ছ ঘোষণা থাকা উচিত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, বিএনপি'র সবার বক্তব্য যদি একসাথে রাখি, বিএনপি একটা অস্থিরতায় ভুগছে দলগতভাবে। তারা শঙ্কায় ভুগছে এক এগারোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না। অন্তর্বর্তী সরকারের চার পাঁচজন একই সুরে যখন কথা বলছেন, তার একটা গুরুত্ব তো আছেই। নির্বাচনের সময়সীমাটা একরকম স্পষ্ট করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি যদি বিবেচনায় নিই তাহলে এর অন্যথা হওয়ার কথা নয়।
অধ্যাপক আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি'র মধ্যে হয়তো এই শঙ্কাও কাজ করছে যে তারা যদি এই মুহূর্তে নির্বাচনে যেতে না পারে তাহলে তাদের জনসমর্থনে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে এমনকি জনসমর্থন ঘুরে যাওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়ে থাকতে পারে।’
সরকার পতনের পরের দুই মাসে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটি সদস্য থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এক হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে বিএনপিকে।
সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘দলের অভ্যন্তরে নির্বাচন নিয়ে চাপ ও দলকে নিয়ন্ত্রণে রাখাও নেতাদের ওই ধরনের বক্তব্যের একটা কারণ হতে পারে। যে কারণে, বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের নেপথ্যে শঙ্কার চেয়ে জোরাল কারণ হিসেবে রাজনৈতিক কৌশল এর কথাই বলছেন।’
অন্যদিকে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে অস্বস্তিকর অবস্থায় থাকলে যেকোনো সেগমেন্ট থেকে অস্থিরতা আসতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক তারানা বেগম।
সূত্র: বিবিসি।
এম হাসান