ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

সর্বস্তরের নেতাকর্মী মাঠ অনুকূলে রাখতে সক্রিয়

ভোটের অপেক্ষায় বিএনপি সুনির্দিষ্ট টাইমলাইন দাবি

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪

ভোটের অপেক্ষায় বিএনপি সুনির্দিষ্ট টাইমলাইন দাবি

দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বিএনপি

দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বিএনপি। আপাতত নির্বাচন ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবছে না। তাই পুরোদমে নির্বাচনমুখী রাজনীতি নিয়ে মাঠে সক্রিয় দলটি।  দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোট হলে বিএনপিই নির্বাচিত হবে এমন আত্মবিশ্বাস নিয়েই বিএনপি নেতাকর্মীরা ভোটের জন্য অপেক্ষা করছেন।
এদিকে অন্তর্বর্তী  সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ২০২৫ সালের শেষদিকে বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার কথা বললেও শুধু নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করে তার আগেই নির্বাচন করা সম্ভব বলেও দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। তবে এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় সাড়ে ৪ মাস পর প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছে বিএনপি।

তবে দলটির পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট টাইম লাইন দাবি করা হচ্ছে। আর সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের টাইম লাইন ঠিক করা হলে সে অনুসারে নির্বাচন কমিশনও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রস্তুত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য  মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তাই আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে অতি দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি করছি। দ্রুত নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্কার কাজ শেষ করে তাদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা উচিত। 
নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক না হলেও সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীরা ঘরে বসে নেই। প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের পাশাপাশি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠ অনুকূলে রাখতে সক্রিয় রয়েছেন। কেন্দ্র থেকে দলের সিনিয়র নেতারাও প্রতিদিনই বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়ে সভা-সমাবেশ করে দলের অবস্থান আরও মজবুত করার চেষ্টা করছেন। এ পরিস্থিতি তৃণমূল পর্যায়ে দলের নেতাকর্মীরা এখন অধিক সক্রিয় হয়েছেন বলে জানা যায়। 
সূত্র মতে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপির নেতাকর্মীরা ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার নিয়ে তোড়জোর শুরু করলেও ভোটের আগে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া আর কোনো সংস্কার চায় না বিএনপি। তারা চায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্য সংস্কারগুলো করতে। বিএনপির দেওয়া ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের আলোকে প্রয়োজনে আরও কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে রাষ্ট্র সংস্কার করতে চায় তারা। তাই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। 
বিএনপির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত বেশ কদফা  অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া প্রতিদিনই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দলের নেতাকর্মীরা দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন। এ কারণে সরকারও এখন চাপের মুখে। তাই এতদিন অন্তবর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা নির্বাচন কবে হবে এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলেও ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথমেই  দেশে সাধারণ নির্বাচন হবে। 
এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ইতিবাচক। তবে সরকার আন্তরিক হলে আরও আগে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। আর উচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ড. মোশাররফ বলেন, যেহেতু পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে আর কোনো বাধা নেই। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। 
জাতির উদ্দেশে দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, নির্বাচন নিয়ে  দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে স্বাগত জানাই। আশা করি অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে জনগণের হাতে ক্ষমতা  দেবে।  দেশের মানুষ দ্রুত ভোটের অধিকার ফিরে পেতে চায়। আমাদের নেতা তারেক রহমান বলেছেন, দ্রুত নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের একটি ধারণা দিয়েছেন, কিন্তু বিএনপি ধারণা নয়, নির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়।
সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের কাজে জোর দিয়েছে। এ মাসেই সবগুলো সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দাখিল শেষ করার কথা রয়েছে। তবে বিএনপিসহ ক’টি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে দ্রুত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করতে। নির্বাচন দিতে দেরি হতে করা হতে পারে এমন সন্দেহ থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের ‘মাইনাস টু ফর্মুলার’ আশঙ্কাও করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারাও দ্রুত নির্বাচন দিয়ে চলে যেতে চান। তবে কিছু সংস্কার কাজ শেষ করে না গেলে এ সরকার প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। তাই তারা দ্রুত সংস্কার কাজ শেষ করতে কাজ করে যাচ্ছে। 
অভিজ্ঞ মহলের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর দেশের নির্বাচনী মাঠ এখন বিএনপির অনুকূলে। তাই দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা চাচ্ছে এই পরিবেশ থাকতে থাকতেই যেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যায়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারবে এমন আশাবাদ থেকেই তারা দ্রুত নির্বাচন চান। আর এ জন্যই দলের নেতাকর্মীরা ভোটের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। 
বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ভোটের আগ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠ নিষ্কণ্টক রাখতে দলের সকল কেন্দ্রীয় নেতারা এখন সারাদেশের বিভিন্ন মহানগর, জেলা ও উপজেলা চষে বেড়াচ্ছেন। তারা সভা-সমাবেশে নির্বাচনের পক্ষে বক্তব্য রাখার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে জনসংযোগ কর্মসূচি জোরদার করছেন।

এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অধিকতর সক্রিয় করে সংসদ নির্বাচনের পথ সুগম করছেন।  আর এ জন্যই অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারের জন্য বেশি সময় না নিয়ে অবিলম্বে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি অব্যাহত রেখেছেন। এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন। দলকে গতিশীল করার পাশাপাশি তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতিও জোরদার করতে বলছেন। 
প্রায় ১৮ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা দল বিএনপির নেতারা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠের প্রস্তুতি আপরও জোরদার করতে নভেম্বরের প্রথম দিন থেকেই নতুন উদ্যমে সারাদেশের সকল জেলা ও মহানগরে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন শুরু করেছে। এর আগেই দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সকল মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে গণসংযোগ কর্মসূচি সফল করতে নিজ নিজ এলাকায় সবাইকে সক্রিয় হতে বলা হয়। 
দলীয় সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩০০ সংসদীয় আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে। নির্বাচনের আগে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা যেন দলীয় কর্মকান্ডে অধিকততর সক্রিয় হয় তারই অংশ হিসেবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মাঝেমধ্যে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিটি সংসদীয় এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব আসনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে বলে সূত্র জানায়। 
এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোকেও কিছু আসন ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আগেবাগেই সমমনা ক’টি দলের ক’জন নেতাকে আসন ছেড়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।

এর মধ্যে রয়েছে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-২ আসন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিকে ঢাকা-১২, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূরকে পটুয়াখালী-৩, গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানকে ঝিনাইদহ-২, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাকে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন,  গণফোরাম সভাপতি মোস্তফা মোহসিন মন্টুকে কেরানী গঞ্জ অথবা পুরনো ঢাকার ১টি আসন,  এলডিপির (একাংশ) সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিমকে লক্ষ্মীপুর-১ আসন। এছাড়াও  কর্ণেল (অব.) অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন এলডিপির আরেক অংশ বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করলে চট্টগ্রামের একটি ও কুমিল্লার ১টিসহ এ দলটিকে ক’টি আসন ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 
৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর প্রফেসর ড, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে ৮ আগষ্ট। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই তারা রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রমে জোর দেয়। সরকারের সংস্কার কর্যক্রমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলও ব্যাপক সাড়া দেয়। তারা সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসও দেয়। বিএনপিও সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। কারণ, দেড় বছর আগে বিএনপিই প্রথম রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়ে জনমত তৈরী শুরু করে।

কিন্তু যখন বিএনপি দেখতে পায় অন্তর্বর্তী সংস্কার করতে গিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তখনই দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের দাবিতে সোচ্ছার হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিএনপি এ পর্যন্ত বেশ ক’বার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ করে। প্রতিবারই সংলাপে গিয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানায়। অন্যান্য সংস্কার এখন না করে শুধু নির্বাচনী সংস্কার কাজ শেষে করে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করার তাগিদও দেয়া হয় দলটিরপক্ষ থেকে।

হুমায়ুন কবির

×