ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বৃহত্তর জোট করার পরিকল্পনা

তিনশ’ আসনেই প্রার্থী দেবে বাম গণতান্ত্রিক জোট

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

তিনশ’ আসনেই প্রার্থী দেবে বাম গণতান্ত্রিক জোট

তিনশ’ আসনেই প্রার্থী দেবে বাম গণতান্ত্রিক জোট

অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার শেষে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেবে তাতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)সহ বাম গণতান্ত্রিক জোট অংশগ্রহণ করবে। তিনশ’ আসনেই বাম গণতান্ত্রিক জোট প্রার্থী দেবে। সে লক্ষ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগেই বাম জোটের পরিধি আরও বড় করারও চিন্তাভাবনা চলছে। জোটের বাইরে থাকা সমমনা দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর জোট বা মোর্চা গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে বাম দল ও জোট সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের রোডম্যাপ চায়। বামগণতান্ত্রিক জোট ইতোমধ্যে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে । বাম দল সূত্রে এ খবর জানা গেছে। 
নির্বাচনে অংশ নিতে ৩০০ সংসদীয় আসনেই প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বাম ধারার ৯টি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাম গণতান্ত্রিক জোট আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে মনে করলে ৩০০ সংসদীয় আসনেই প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এই জোটের। 
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)র সভাপতি মুহাম্মদ শাহ আলম জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমাদের মূল দাবি হলো নির্বাচনী রোড ম্যাপ ঘোষণা। নেতৃবৃন্দের কথা সরকার সংস্কার করুক। পাশাপাশি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা অত্যন্ত জরুরি। নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ করার জন সরকার সে সংস্কারটা করুক। সে জন্য কালক্ষেপণ করার দরকার নেই। নির্বাচন দিতে দীর্ঘসূত্রতা হলে সরকারের কর্মকা- বিতর্কিত হবে। আমরা নির্বাচনে জোটগত ভাবেই যাব। পাশাপাশি দলীয় প্রস্তুতিও নিচ্ছি। তিনশত আসনেই প্রার্থী দেব। সেটা মাথায় রেখেই দলীয় কার্মকা- চালিয়ে যাচ্ছি। সব জায়গাতেই আমাদের মার্কাটা নিয়ে যাব। 
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স জনকণ্ঠকে বলেন, আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনী প্রস্তুতিও চলছে। তবে সংস্কার প্রস্তাব ও নির্বাচনী রোডম্যাপ না দেখে নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত  চূড়ান্ত করার সুযোগ নেই। নির্বাচনব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য আমরা সরকারকে একাধিকবার বলেছি। নতুন নির্বাচন কমিশন কাজ শুরু করেছে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের মূল দাবি জিনিসপত্রের দাম কমানো। এবং জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং আমাদের দেশের জানমালের নিরাপত্তা। আমরা দেখতে পারছি সরকার আছে। এই সরকার হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তার সামনে একটি প্রধান কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেওয়া। সেটার জন্য নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ব্যবস্থা করে নির্বাচনী রোডম্যাপ ও সুনির্দিষ্ট নির্বাচন তারিখ ঘোষণার জায়গায় যাওয়া দরকার। 
অন্যদিকে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী নির্বাচনে আমার দল ও জোটগত ভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার দলগতভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোথায় কোথায় প্রার্থী করা যায় যে ব্যাপারে খোঁজ খবর রাখা হচ্ছে। তাদের মানসিক, আর্থিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি বিষয়ে  জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। যার যার দলগতভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর পরেও আমরা বামজোটের মধ্যে আলোচনা করে সমন্বয় করে একক পার্থী হিসেবে দেব। বামজোটগত ভাবে আছে এর পাশাপাশি বাইরে যে দল আছে তাদের নিয়ে বৃহত্তর জোট বা মোর্চা করা যায় কিনা। সেভাবেই তিনশ’ আসনেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। 
এরই মধ্যে ৯ ডিসেম্বর সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনে ১০ প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সের পাঠানো বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়। সংবিধানের অসম্পূর্ণতা দূর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পাঠানো বক্তব্যে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গৃহীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের’ অঙ্গীকার অবলম্বন করে ১৯৭২-এ প্রণীত সংবিধানের মূলভিত্তি অর্থাৎ চার মূলনীতি ঠিক রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ত্রুটি, দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা দূর করে সংবিধানের পূর্ণতা আনার জন্য সিপিবির কয়েকটি প্রস্তাব  রয়েছে।
এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, মূলনীতির ক্ষেত্রে আদিবিধানের ৪-নীতি বহাল রাখা; সংবিধানে আদিবাসীসহ অন্যান্য জাতিসত্তার স্বীকৃতি দেওয়া; জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের নিশ্চয়তা দেওয়াকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেওয়া এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। আরও রয়েছে, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়া; নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকার পুনঃপ্রবর্তন; আর্থিক ক্ষমতার নিশ্চয়তাসহ স্থানীয় সরকারের প্রকৃত ও পূর্ণ ক্ষমতায়ন ও রাষ্ট্র প্রশাসনের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ করা, বরাদ্দ ও কাজ সুনির্দিষ্ট করা; নারী আসনের সংখ্যা বাড়ানো, সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা; সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করা; এটি না হওয়া পর্যন্ত ‘না’ ভোট ও প্রতিনিধি প্রত্যাহার (রাইট টু রিকল) ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ কালাকানুন বাতিল করা।
এদিকে জোটের নেতারা বলছেন, আন্দোলনের পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে স্থানীয় পর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের চেষ্টা থাকবে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়া। দুই দলের বাইরে বিকল্প শক্তি হিসেবে আগামী নির্বাচনে নিজেদের তুলে ধরতে চাইছে এ জোট। জোটের শীর্ষ নেতাদের মতে, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ টাকার খেলা, পেশিশক্তি, সাম্প্রদায়িকতা, ‘প্রশাসনিক কারসাজিনির্ভর’ বিদ্যমান গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিতে রাজপথের আন্দোলন চলছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। মূলত এর মধ্যে দিয়েই দল গোছানোর কাজ চলছে। তাদের দাবি, নির্বাচনকে শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে দেখা হচ্ছে না। এটা আন্দোলন-সংগ্রামের অংশ এবং স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠক তৈরির অন্যতম সুযোগ।
এ জোটে আছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাসদ- মার্কসবাদী, ওয়ার্কার্স পার্টি- মার্কসবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। অনেক আগেই বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও গণসংহতি আন্দোলন বাম  জোট থেকে বেরিয়ে সাত দলের সমন্বয়ে গনতন্ত্র মঞ্চ গঠন করেছে। জোটের নেতা-কর্মীরা বলছেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হলে বাম গণতান্ত্রিক জোট প্রায় সব আসনেই প্রার্থী দেবে। 
নেতৃবৃন্দ বৃহত্তর জোটের কথা বললেও একাধিকবার ভাঙনের কারণে বামদের শক্তি কমছে। ভোটের হিসাবে দল ও জোটসংখ্যার তুলনায় বেশ পিছিয়ে আছে বামপন্থিরা। বিভক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ দেশের বাম প্রগতিশীল দলগুলো অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশে রাজনীতিতে বামধারার দলগুলো বহু ভাগে বিভক্ত। বামদলগুলো না পারছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে, না পারছে বিএনপির মত সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনকে সমর্থন দিতে। আর এ কারণে ক্রমশ সংকুচিত এবং সংকটে পড়েছে দেশের বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলো।

এদিকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক (বাম) দলের সংখ্যা ১০টি। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল)- সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি- সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)- সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ)- চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি- সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি- সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) ।
তবে এর বাইরেও অনিবন্ধিত রয়েছে আরও কমপক্ষে ১৪টি দল। অনিবন্ধিত দলগুলো হচ্ছে গণতন্ত্রী পার্টি-সভাপতি ব্যারিস্টার মো. আরশ আলী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, বাসদ-আহ্বায়ক মবিনুল হায়দার চৌধুরী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)- আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি- সভাপতি জাকির হোসেন, গণসংহতি আন্দোলন-প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি-সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ- আহ্বায়ক প্রফেসর আবদুস সাত্তার, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন-আহ্বায়ক হামিদুল হক, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল-সভাপতি বদরুদ্দীন উমর, জাতীয় গণফ্রন্ট- সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চ- আহ্বায়ক মাসুদ খান, কমিউনিস্ট কেন্দ্র- আহ্বায়ক ড. ওয়াজেদ ইসলাম খান, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (সাইদ আহমেদ)।
বাম দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন ১৪ দলীয় জোটে আছে ১০টি দল। এই দলগুলো হলো- ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), জাসদ (বাদল), ন্যাপ (মোজাফফর), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, বাসদ (রশীদ খান), কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, সাম্যবাদী দল। আর ২০ দলীয় জোটে রয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ)- চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (সাইদ আহমেদ)।

এর বাইরে বাম দলগুলোর আরও ২টি জোট রয়েছে। সিপিবি, বাসদ, বিপ্লবী  ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, বাসদ (মার্ক্সবাদী) মিলে গঠন করা হয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। আর জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এই তিন দল নিয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় মুক্তি জোট।

×