ছবি: সংগৃহীত
গত ৫ ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেরিয়ে আসছে বেশ অনেক মন্ত্রী ও এমপিদের কুকীর্তি। ইতিমধ্যে বেশ কিছু মন্ত্রী ও এমপি ধরা পড়লেও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন অনেকেই। ইতিমধ্যে অর্থ পাচার করে বিদেশে ফ্ল্যাট, বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা লাভ ও দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করা অনেকর নাম জানা গেছে। এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপিরাও রয়েছেন। অনেকেই সংবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহনের পর নির্বাচনী হলফনামায় তথ্য গোপন করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। পরে তাদের কেউ কেউ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আসনেও বসেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য ছিলেন, এমন ২৪ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব (কারও কারও ক্ষেত্রে রেসিডেন্স কার্ড বা গ্রিন কার্ড) থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেতে চাইলে একজন ব্যক্তিকে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কোনো কোনো রাষ্ট্রে রেসিডেন্স কার্ড বা গ্রিন কার্ড পাওয়ার পরের ধাপে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রভাবশালী ১৮০ জনের (১৫ অক্টোবর পর্যন্ত) অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে দুদক। সেই অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত ২৪ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব বা রেসিডেন্স কার্ড থাকার ব্যাপারে তথ্য পেয়েছে দুদক। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে পারেন না।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, এমন কোনো ব্যক্তির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া বা মন্ত্রিত্ব লাভের সুযোগ নেই। তথ্য গোপন করে যদি এ কাজ হয়ে থাকে, তাহলে আইন ও সংবিধান পরিপন্থী কাজ হয়েছে।
দুদকের তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক পাঁচজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নাগরিকত্ব রয়েছে যুক্তরাজ্যে। তাঁরা হলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল, মো. তাজুল ইসলাম, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও মো. মাহবুব আলী। তাঁদের মধ্যে গত ১৫ সেপ্টেম্বর মাহবুব আলীকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বা গ্রিন কার্ড রয়েছে সাবেক চারজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ সাতজন সংসদ সদস্যের। দুদকের অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত যাঁদের নাম এসেছে, তাঁরা হলেন আব্দুস শহীদ, নসরুল হামিদ, জুনাইদ আহ্মেদ, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ), মাহফুজুর রহমান ও সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ। তাঁদের মধ্যে সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তারের পর এখন কারাগারে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আবদুস সোবহানের পরিবারের যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক ফ্ল্যাট বা বাড়ি থাকার বিষয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) তাদের ওয়েবসাইটে গত বছরের জানুয়ারি মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন গোলাপ। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে একে একে ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি (ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ কোটি টাকা)।
দুদকের অনুসন্ধানে কানাডার নাগরিকত্ব রয়েছে, এমন ছয়জনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে একজন সাবেক মন্ত্রী, অন্যরা সাবেক সংসদ সদস্য। এর মধ্যে রয়েছেন আবদুর রহমান, মাহবুব উল আলম হানিফ, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (নাসিম), শামীম ওসমান, শফিকুল ইসলাম (শিমুল) ও হাবিব হাসান।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব রয়েছে সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এবং জাপানে থাকার অনুমতি (রেসিডেন্স কার্ড) রয়েছে সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের। সাবেক সংসদ সদস্য (টাঙ্গাইল-২ আসন) তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির জার্মানির নাগরিক এবং সাবেক সংসদ সদস্য (ময়মনসিংহ-১১) এম এ ওয়াহেদ পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকত্ব নিয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধানে যে ২৪ জনের নাম এসেছে, তাঁদের মধ্যে পাঁচজন এখন কারাগারে। বাকিরা গত ৫ আগস্টের পর আর প্রকাশ্যে আসেননি। তাঁদের মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ রয়েছে। আবার অনেকে দেশ ছেড়েছেন বলে প্রচার আছে। যে কারণে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে তাঁদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আইনকানুন, বিধিবিধান ও নৈতিকতার তোয়াক্কা করত না বলে উল্লেখ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খুন-গুম ও ভিন্নমতকে দমনের পাশাপাশি দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা ব্যক্তিদের দলীয় মনোনয়ন দিয়ে মন্ত্রী-এমপি করার দায়ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিতে হবে। পাশাপাশি বিগত নির্বাচন কমিশনগুলোকেও এ বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি বলেন, পুরো নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। অবশ্যই এর বিচার হতে হবে।
সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাঁদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, তাঁরা বড় অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন—এমন তথ্য দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। যাঁরা টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদকের তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সালমান এফ রহমানের সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব থাকলেও তাঁর ‘বাগানবাড়ি’ যুক্তরাজ্যে। সেখানে তাঁর চারটি বাড়ি রয়েছে।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আরব আমিরাতে ৬২০টি বাড়ি কিনেছেন। যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৮ কোটি ডলার (প্রায় ৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা)। গত ৩১ অক্টোবর গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি উল্লেখ করেছে সিআইডি। অবশ্য সিআইডির বিজ্ঞপ্তির আগেই গত সেপ্টেম্বর মাসে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিপুল সম্পদ থাকার বিষয়টি তুলে ধরে।
দুদক সূত্র বলছে, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাড়ি রয়েছে লন্ডনে। তাঁর এক মেয়ে আগে থেকেই লন্ডনে থাকেন।
আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমান কানাডার নাগরিক। দেশটির টরন্টো শহরে তাঁর বাড়ি রয়েছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়া দুবাইয়ের আজমান শহরে তাঁর আরেকটি বাড়ি রয়েছে।
কানাডায় বাড়ি, ব্যবসাসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর (নাসিম)। তাঁর মেয়ে কানাডায় থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি রয়েছে মানিকগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন মাহমুদ জাহিদের। তাঁর মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
নাটোরের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুলের বাড়ি রয়েছে কানাডার টরন্টোর নিকটবর্তী স্কারবরো শহরে। গত বছরের শুরুতে বাড়িটি কেনা হয়। সংসদ সদস্যদের ঘনিষ্ঠ এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বাড়িটি কিনতে ১৭ লাখের বেশি কানাডিয়ান ডলার খরচ হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ১২ কোটি টাকা।
এ ছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও তাঁর ছেলের নামে দুবাইয়ে বড় ধরনের বিনিয়োগ থাকার বিষয়টি জানতে পেরেছে দুদক।
অনুসন্ধানে যুক্ত দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাঁদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, তাঁদের সবার বিদেশে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখছেন তাঁরা। অনুসন্ধান শেষে দ্বৈত নাগরিকত্বসহ বিদেশে বাড়ি-বিনিয়োগ ও টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য মামলায় উল্লেখ করা হবে।
বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে যাঁরা দেশে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের মর্যাদা-সুবিধা ভোগ করেছেন, তাঁরা আসলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন বলে মনে করেন দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁদের শপথ গ্রহণই ছিল অবৈধ। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হওয়ার বিষয়টি এখন আর অবাক হওয়ার মতো ঘটনা নয়। এর কারণ দেশে যেভাবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারহীনতার বিকাশ হয়েছে, তাতে এগুলো স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তথ্য গোপন ও প্রতারণা করা ওই সব প্রভাবশালীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এখন জরুরি।
শিহাব