পুরোদমে নির্বাচনের পথে বিএনপি
পুরোদমে নির্বাচনের পথে বিএনপি। আপাতত নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প চিন্তা করছে না দলটি। তাই দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিলেও ভোটের আগে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া আর কোনো সংস্কার চায় না বিএনপি। তারা চায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে রাষ্ট্র মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে।
বিএনপি নেতাকর্মীরা ইদানীং কথায় কথায় জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছেন। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দ্রুত নির্বাচনের কথা সরাসরি বলেছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। এ ছাড়া প্রতি দিনই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন। এ কারণে সরকারও এখন চাপের মুখে। সরকারের একজন উপদেষ্টা সম্প্রতি বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবি প্রসঙ্গে বিরক্তি প্রকাশ করে বক্তব্য দিলে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
অভিজ্ঞ মহলের মতে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো সংস্কার কাজ শেষ করার পরই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে অবস্থান করছে। তবে সংস্কারের কাজে গতিও বাড়ানো হয়েছে। তার পরও বিএনপির পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে। নির্বাচন দিতে দেরি হতে করা হতে পারেÑ এমন সন্দেহ থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের ‘মাইনাস টু ফর্মুলার’ আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর দেশের নির্বাচনী মাঠ এখন বিএনপির অনুকূলে। তাই দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা চাচ্ছেন এই পরিবেশ থাকতে থাকতেই যেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যায়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারবেÑ এমন আশা থেকেই তারা দ্রুত নির্বাচন চান।
এদিকে ভোটের আগ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠ নিষ্কণ্টক রাখতে দলের সকল কেন্দ্রীয় নেতা এখন সারাদেশের বিভিন্ন মহানগর, জেলা ও উপজেলা চষে বেড়াচ্ছেন। তারা সভা-সমাবেশে নির্বাচনের পক্ষে বক্তব্য রাখার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে জনসংযোগ কর্মসূচি জোরদার করছেন। এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অধিকতর সক্রিয় করে সংসদ নির্বাচনের পথ সুগম করছেন। আর এ জন্যই অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারের জন্য বেশি সময় না নিয়ে অবিলম্বে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি অব্যাহত রেখেছেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠের প্রস্তুতি আরও জোরদার করতে নভেম্বরের প্রথম দিন থেকেই নতুন উদ্যমে সারাদেশের সকল জেলা ও মহানগরে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন শুরু করেছে বিএনপি। এর আগেই দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সকল মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে গণসংযোগ কর্মসূচি সফল করতে নিজ নিজ এলাকায় সবাইকে সক্রিয় হতে বলা হয়েছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩০০ সংসদীয় আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে। নির্বাচনের আগে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা যেন দলীয় কর্মকা-ে অধিকততর সক্রিয় হয় তারই অংশ হিসেবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রায়ই ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিটি সংসদীয় এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
প্রায় দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভোটের মাঠে সক্রিয় হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোকেও কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আগেভাগেই সমমনা ৫টি দলের ৬ জন নেতাকে ৬টি আসন ছেড়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই এই ৬ নেতাকে চিঠি দিয়ে নিজ নিজ সংসদীয় আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছে বিএনপি।
এই ৬ নেতা হলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা। সমমনা দলের এই ৬ নেতার মধ্যে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-২ আসন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিকে ঢাকা-১২, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূরকে পটুয়াখালী-৩, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানকে ঝিনাইদহ-২ এবং জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাকে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়াও গণফোরাম সভাপতি মোস্তফা মোহসিন মন্টুকে কেরানীগঞ্জ অথবা পুরান ঢাকার ১টি আসন, এলডিপির (একাংশ) সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিমকে মৌখিকভাবে লক্ষ্মীপুর-১ এবং কর্নেল (অব) অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন এলডিপির আরেক অংশ বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করলে চট্টগ্রামের একটি ও কুমিল্লার ১টিসহ এ দলটিকে ক’টি আসন ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সূত্র জানায়।
উল্লেখ্য, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে ৮ আগস্ট। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই তারা রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রমে জোর দেয়। সরকারের সংস্কার কর্যক্রমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলও ব্যাপক সাড়া দেয়। তারা সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসও দেয়। বিএনপিও সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। কারণ, দেড় বছর আগে বিএনপিই প্রথম রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়ে জনমত তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু যখন বিএনপি দেখতে পায়, অন্তর্বর্তী সংস্কার করতে গিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তখনই দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিএনপি এ পর্যন্ত তিনবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ করেছে। প্রতিবারই সংলাপে গিয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানায়। অন্যান্য সংস্কার এখন না করে শুধু নির্বাচনী সংস্কার কাজ শেষে করে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করার তাগিদও দেওয়া হয় দলটির পক্ষ থেকে। বিএনপির সঙ্গে আগে যুগপৎ আন্দোলন করা সমমনা বেশ ক’টি দলও দ্রুত নির্বাচন দাবি করে।
বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবির পরও অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কাজ নিয়ে পুরোদমে ব্যস্ত সময় পার করছে। এ জন্য ৬টি কমিশন গঠন করেছে। ৬টি কমিশন হচ্ছে, সংবিধান পুনর্গঠন কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, পুলিশ বিভাগ সংস্কার কমিশন, প্রশাসন সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সংস্কার কমিশন। কমিশনগুলো তাদের কাজ শেষ করতে দফায় দফায় বৈঠক করছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই কমিশনগুলো সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে দেবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। তাই জনগণের প্রধান দাবি দ্রুত নির্বাচন। তাই জনগণের পক্ষে বিএনপিও দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ দাবি করছে। আমরা চাই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে সংস্কার প্রয়োজন তা শেষ করে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের মানুষ তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। তাই তারা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।
বিএনপির মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপির গণদাবি দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করে জনপ্রতিনিধিদের কাছে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেবে বলে আমরা আশা করছি। তাই এ সরকারের দ্রুত জরুরি সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা উচিত। নির্বাচনের পর সংস্কার কাজ শেষ করবে নির্বাচিত সরকার। এ জন্য বিএনপি আগেই ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে।