সাবেক আওয়ামী সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল এবং কন্যা নাফিসা কামাল সম্পদের পাহাড় জমিয়ে দেশ ছেড়েছেন।
সরকারী বিভিন্ন প্রকল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে সাম্রাজ্য বানিয়েছেন সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ের মতো দেশগুলোতে।
তার ক্ষমতার প্রভাবে তার মেয়ে নাফিসা কামালও বানিয়েছেন অঢেল সম্পত্তির পাহাড়। সাবেক ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হওয়ার কারণে কোনো সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।
কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার (বিএফআইইউতে) অভিযানে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য অনিয়মের প্রমাণ।
দীর্ঘ ১৬ বছর কুমিল্লা-১০ আসনের এমপি লোটাস কামাল আওয়ামী লীগের হয়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। আর এই সুযোগেই তিনি দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন।
আওয়ামী সরকারের বিপদ মাথা থেকে এড়াতে ১৫ জুলাই আন্দোলনের শুরুতেই দেশ ছেড়ে পালান লোটাস ও নাফিসা কামাল। আর পালানোর আগে নিজেদের ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছেন অধিকাংশ পরিমাণ সম্পদ।
আওয়ামী সরকারের পতন হলে গত ২২ আগস্ট লোটাস কামাল, তার স্ত্রী কাশমিরী কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামালের ব্যাংক হিসাব মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা সংশ্লিষ্ট ধারানুযায়ী জব্দ করা হয়েছে বলে জানায় বিএফআইইউর। চিঠিতে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দেওয়া আছে।
বিএফআইইউ আরও জানায়, কোনো হিসাব স্থগিত করা হলে হিসাব জব্দ করাদের সমস্ত লেনদেনের উপায় বন্ধ থাকবে।
বিএফআইইউর আরও জানায় দেয়, স্থগিত হিসাবের সংশ্লিষ্ট তথ্য চিঠি দেওয়ার তারিখ থেকে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের কাছে পাঠানোর জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত জানুয়ারী থেকে আগস্ট পর্যন্ত কামাল দম্পতি এবং মেয়ে নাফিসা লোটাস ব্যাংক থেকে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা তুলেছেন। যার বেশিরভাগই দেশের বাইরে পাচার করেছেন। তবে তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে নেওয়া হলে মোট ৭৩০কোটি টাকার মধ্যে ৮২ কোটি টাকা তারা তুলতে পারেননি।
দুদক জানায়, কামাল পরিবারের সদস্যরা মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে সরকার নির্ধারিত অতিরিক্ত ফি হিসেবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
২০২২ সালের জুলাইয়ে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হলে তাদের কাছে কর্মী পাঠানোর জন্য ১ হাজার ৫২০টি রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা দেয় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু নির্বাচন করা হয় মাত্র ২৫টির নাম। যা নির্বাচনের কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা ছিল না। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা। কিন্তু কামালের পরিচালিত সিন্ডিকেটটি নিয়েছে কর্মীপ্রতি ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
২০১০ সালে শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিতেও মূল ছিলেন লোটাস কামাল। তিনি শেয়ারবাজারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এবং তা সস্তায় কেনার পর বিদেশে পাচার করে দিতেন। সে সময় তার চক্র প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছিল।
গত ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায়, কামালের সম্পদের পরিমাণ ৪১ কোটি ৯০ লাখ ৫৩ হাজার টাকা দেখানো হলেও, স্ত্রীর সম্পদ দেখানো হয়েছে ৬২ কোটি ২৭ লাখ ১৯ হাজার টাকা। কামাল উল্লেখ করেন, স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং পাঁচ নাতি-নাতনিকে দান করে কিছু সম্পদ কমিয়েছেন।
তবে সূত্রানুযায়ী কামালের হলফনামায় উল্লিখিত সম্পদের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন।
দুদকের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার নিকুঞ্জে জোয়ারসাহারায় রয়েছে আধুনিক বাণিজ্যিক ভবন ‘লোটাস কামাল টাওয়ার’। বাড্ডা ও উত্তরায় রয়েছে তার বহুতল বাড়ি ও দামি ফ্ল্যাট। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে শেয়ারবাজারে। ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রমাণ মিলেছে সঞ্চয়পত্রে। লোটাস কামাল প্রপার্টিজ ও অরবিটাল এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে বিপুল বিনিয়োগ করেছেন লোটাস কামাল।
এ ছাড়া, স্ত্রী কাশমিরী কামালের নামে ঢাকার গুলশান, বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্লট-ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় তার নিজের ও স্ত্রীর নামে রয়েছে বিপুল পরিমাণ জমি। স্ত্রীর নামে বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে নগদ অর্থ। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ারেও বিনিয়োগ রয়েছে কাশমিরী কামালের। লোটাস কামাল প্রপার্টিজ ও সৌদি বাংলাদেশ কন্ট্রাকটিং কোম্পানিসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন কাশমেরী। তার সঞ্চয়পত্র রয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকার। তিনটি দামি গাড়ির মালিক তিনি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লোটাস কামালের প্রায় ৮০ কোটি টাকা আছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালে লোটাস কুমিল্লা জেলা অন্তর্ভুক্তি শর্তে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন দেন। তার বাড়ির পাশেই সাড়ে ১০ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় সেন্টারটি।
তবে স্থানীয় সূত্র দাবি, এই প্রকল্প এলাকায় কোনো কার্যকর ফল বয়ে আনেনি। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ, সরঞ্জাম সরবরাহ এবং অন্যান্য কাজে কামালের গড়া সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের কমিশন আদায় হয়েছে।
২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত কুমিল্লার সদর দক্ষিণ, নাঙ্গলকোট ও আদর্শ সদর উপজেলায় ৪২টি খাল খননের জন্য ১৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও, কামালের নির্দেশে তার সিন্ডিকেট কাজ না করেই পুরো অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই ঘটনায় গত ১৪ অক্টোবর আদালতে মামলা দায়ের করেছেন সদর দক্ষিণ জেলা কৃষক সমবায় ঐক্য পরিষদের সভাপতি মুহম্মদ আখতার হোসাইন। মামলায় কামালের ছোট ভাই গোলাম সারোয়ার, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাবলু, এপিএস মিজানুর রহমান, জনপ্রতিনিধিসহ ৪৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।
তানজিলা