কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত ৫ বারের এমপি, হুইপ ও সাবেক রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হকের আপন ভাতিজা তোফায়েল আহমেদ। ক্ষমতার প্রায় ১৬ বছরে চাচার (কাকা) দাপট খাটিয়ে চৌদ্দগ্রামসহ দক্ষিণ কুমিল্লার ঠিকাদারী বাণিজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলেন। শূণ্য থেকে সূবর্ণ এসময়ে কয়েকশত কোটি টাকার মালিক বনে যান তোফায়েল। তিনি দম্ভ করে বলতেন ‘আমার কাক্কা ক্যাবিনেট মিনিস্টার’। বিভিন্ন ফোরামে তার দাপটে নেতাকর্মীসহ এলাকার লোকজন ছিলেন অতিষ্ঠ। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সাথে সাথে সেই তোফায়েলও এখন কাকার পথ ধরে পলাতক।
সূত্র জানায়, মুজিবুল হক রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালীন নিয়োগ, বদলী, রেলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকার বরাদ্দসহ ঠিকাদারী-টেন্ডার কাজে কমিশন বাণিজ্যেরও ছিল স্বর্ণযুগ। দীর্ঘ ওই সময়ে রেল ভবনে সাবেক যুগ্মসচিব এ কে এম জি কিবরিয়া মজুমদারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ডজনাধিক লুটেরা সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট ওই সুবর্ণ সময়ে হঠাৎ করে কেউ হাজার কোটি টাকা থেকে কেউ কেউ শতকোটি টাকার মালিক বনে যান বলে এলাকায় দীর্ঘ সময় থেকে আলোচনায় থাকলেও ক্ষমতার দাপটে মুখ খুলতে সাহস পাননি কেউ। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই সিন্ডিকেটের প্রধান কিবরিয়াসহ তৎসময়ে সক্রিয় সদস্য এসএন ইউসুফ, খালেদ মাহমুদ চঞ্চল, রুপম মজুমদার, মোশারেফ হোসেন, আবুল বশর, খোরশেদ আলম প্রকাশ ক্যাসেট আলম, ভাতিজা জাকির হোসেন স্বপন, শ্যালক নাছির, মন্ত্রীর স্ত্রী হনুফা আক্তার রিক্তাসহ ডজনাধিক সিন্ডিকেট সদস্যের রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যাওয়ার বিষয়টি এখন এলাকার সাধারণ মানুষেরও মুখে মুখে। লুটপাট, হামলা-মামলা-সন্ত্রাস, জনহয়রানীতেও ছিলেন তারা সর্বগ্রাসী। সরকার পরিবর্তনের পর এদের মধ্যেও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন অনেকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক এমপি ও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের ক্ষমতার গত প্রায় ১৬ বছরে তার ভাতিজা তোফায়েল আহমেদ চাচার দাপট খাটিয়ে তার শ্যালক তৌহিদকে নিয়ে চৌদ্দগ্রামসহ দক্ষিণ কুমিল্লায় শক্তিশালী ঠিকাদার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এ সময় এলজিইডি, শিক্ষাপ্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ত্রাণ ও পূনর্বাসনসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ঠিকাদারী কাজে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করেন। জানা যায়, ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল চৌদ্দগ্রাম উপজেলা এলজিইডিতে প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন মো. নুরুজ্জামান। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত শুধু ৩ বছরেই তোফায়েল তার মেসার্স পলি এণ্টারপ্রাইজের নামে ১৮টি বড় প্রকল্পে ৩৭ কোটি ৫৭ লাখ ৩৫ হাজার ৪০৩ টাকার কাজ হাতিয়ে নেন। সূত্র জানায়, এলজিইডি-কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে অনুসন্ধান চালালে ওই সময়ে অর্থের অংক অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এসব কাজের মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, এসও, কার্যসহকারীদের যোগসাজশে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা করা হলেও কাজের কাজ তেমনটা হয়নি। এতে করে কাজ শেষ না হতেই বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। সূত্র জানায়, উপজেলার ২নং উজিরপুর ইউনিয়নের মিয়াবাজার ভায়া শিবের বাজার-চকলক্ষ্মীপুর সড়কটিতে ব্যয় করা হয় ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৩৯ হাজার ৬১০ টাকা। ২০২৩ সালের ২১ মে যেনতেন করে কাজ শেষ করায় সড়কটিতে এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। কাজ তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট এসও মিজানুর রহমান, কার্যসহকারী আবুল কাসেমসহ সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে এ কাজটিতে যেমন ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে, তেমনিভাবে প্রতিটি কাজেই অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে সরকারি টাকা লুটেপুটে খাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া কুমিল্লা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসকের সময়ে তোফায়েল চৌদ্দগ্রামে ছিলেন ওই পরিষদের অঘোষিত সদস্য। ওই সময় চাচার দাপটে নামে-বেনামে তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আনতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার ঠিকাদারী কাজও ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। তোফায়েল আহমেদ ও মোস্তফা জামান লিটন ঠিকাদার নামে যেনতেনভাবে তৎসময়ে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করে হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারি অর্থ। ঠিকাদারী কাজের নিয়ন্ত্রণ-বাণিজ্যের পাশাপাশি রেল মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে একসময়ের কপর্দকহীন তোফায়েল চাচার বদৌলতে এখন কয়েকশত কোটি টাকার মালিক বলে এলাকায় আলোচনায় রয়েছে। তার এই টাকার একটি বৃহৎ অংশ লন্ডনে অবস্থানরত তার শ্যালক হাবিবুর রহমানের নিকট ইতোমধ্যে পাচার করে দেয়া হয়েছে বলেও এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। এছাড়া কুমিল্লা নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার মদিনা মসজিদ রোডে ৮ শতকের মূল্যবান প্লট, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, ঢাকার ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাটসহ কুমিল্লা ও নিজ এলাকায় বিভিন্ন স্থানে অঢেল সম্পদসহ প্লট-ফ্ল্যাট ও ব্যাংকে নামে-বেনামে তার কোটি কোটি রয়েছে বলেও জানা গেছে।
* রেল সিন্ডিকেটের প্রধান কিবরিয়া ধরা পড়লেও অধরা ইউসুফ-আলম-মোশারেফসহ ডজনাধিক লুটেরা:
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মুজিবুল হক রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এসময় রেলের বিভিন্ন পদে বড় ধরনের নিয়োগসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজে সরকারি বরাদ্দ ছিল। ওই সময়টিতে রেল মন্ত্রণালয়-রেল ভবন, মন্ত্রীর সরকারি বাসায় এবং কুমিল্লা শহরসহ নির্বাচনি এলাকা চৌদ্দগ্রামের সর্বত্র একান্ত সচিব (পিএস) এ কে এম জি কিবরিয়া মজুমদার, ব্যক্তিগত সহকারী এসএন ইউসুফ, খোরশেদ আলম প্রকাশ ক্যাসেট আলম, খালেদ মাহমুদ চঞ্চল, রুপম মজুমদার, মোশারেফ হোসেন, আবুল বশর, ভাতিজা জাকির হোসেন স্বপন, তোফায়েল আহমেদ, শ্যালক নাছিরসহ মন্ত্রীর আস্থাভাজনদের ছিল স্বর্ণযুগ ও দোর্দন্ড দাপট। মন্ত্রীর স্ত্রী হনুফা আক্তার রিক্তাসহ উল্লেখিতদের ম্যানেজ করে রেল মন্ত্রণালয়সহ কুমিল্লা ও চৌদ্দগ্রামের যে কোনো ধরনের কাজ-তদবিরে সফলকাম হতেন যে কেউ। রেলমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়কে ঘিরে ডজনাধিক এ সিন্ডিকেট সদস্যরা রাতারাতি বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যাওয়ার বিষয়টি তৎসময়ে ক্ষমতার দাপটে কেউ আলোচনা না করলেও এখন তা এলাকার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। এদের মধ্যে পিএস কিবরিয়া ও চঞ্চল গ্রেফতার হলেও মন্ত্রীসহ অন্যরা অধরা থেকে রয়েছেন আত্মগোপনে।
* রেলওয়ের ‘কালো বিড়াল’খ্যাত এ কে এম জি কিবরিয়া মজুমদার:
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কোমরকড়া গ্রামের মৃত মফিজ উদ্দিন আহম্মদ মজুমদারের ছেলে গোলাম কিবরিয়া মজুমদার একসময় সংসদ সবিচালয়ের সাধারণ কর্মচারি ছিলেন। চৌদ্দগ্রাম থেকে নির্বাচিত এমপি মুজিবুল হক রেলমন্ত্রী হওয়ার পর কিবরিয়াকে তার একান্ত সচিব (পিএস) নিয়োগ দেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি কিবরিয়াকে। মন্ত্রীর একান্ত সচিবের পদকে পুঁজি করে উল্লেখিত সিন্ডিকেট সদস্যদের নিয়ে রেলের বড় বড় ঠিকাদারি কাজের কমিশন ও রেলে নিয়োগ বাণিজ্যের দুর্নীতি করে বনে যান হাজার কোটি টাকার মালিক। রেল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চোখে কিবরিয়া হয়ে ওঠেন রেলওয়ের ‘কালো বিড়াল’। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রতিহত করার কাজে নিয়োজিত থাকা আওয়ামী ক্যাডার কিবরিয়া শেখ হাসিনার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান। এরপর সুযোগ বুঝে সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিজিবির হাতে আটক হন কিবরিয়া। বর্তমানে রেলওয়ের এই ‘কালো বিড়াল’ জেলহাজতে বন্দি। পতিত সরকারের টানা আট বছরে তিনি অঢেল অর্থ সম্পদের মালিক বনেছেন। মজুমদার এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে রেলওয়ের সঙ্গে চুটিয়ে ব্যবসা করেছেন রেলওয়ের গোলাম কিবরিয়া। জানা গেছে, বিদেশে সম্পদ ছাড়াও কুমিল্লা এবং রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় তার একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট ও বহুতল বাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে বাসাবো নন্দীপাড়া এলাকায় রয়েছে ছয়তলা বাড়ি। রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে একাধিক প্লট, গুলশানে অন্তত চারটি ফ্ল্যাট এবং একটি আবাসন কোম্পানিতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশে কিবরিয়ার অঢেল সম্পদ রয়েছে। এসব নিয়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধানের পর প্রতিবেদন পাঠানো হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ দুদকে। কিন্তু এ বিষয়ে দুদক থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে ২০১৯ সালে মুজিবুল হক রেলমন্ত্রী থেকে বাদ পড়লে কিবরিয়া কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ সময় দুদক তার বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান ফাইল খোলে। পরে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে গোলাম কিবরিয়া রেলে নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ছাড়াও রেলের বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) এবং ডিজি নিয়োগে বিপুল অঙ্কের ঘুসবাণিজ্য করেছেন। তার আস্থাভাজন না হলে রেলে ডিজি পদে নিয়োগ পাওয়া ছিল অসম্ভব।
* মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী এক সময়ের শিবির নেতা এসএন ইউসুফ: চৌদ্দগ্রাম উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের (রেলমন্ত্রীর ইউনিয়ন) ছেঁওরিয়া গ্রামের একসময়ের বাবুর্চি মৃত বজলুর রহমানের ছেলে এসএন ইউসুফ। পরিবারে দরিদ্রতার কারণে তিনি চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সদরের একটি বাড়িতে লজিং থেকে নজ্মিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় পড়তেন এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চৌদ্দগ্রাম নজ্মিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা শাখার সাথী ছিলেন। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদের ২০১৬ সালে চৌদ্দগ্রামের এক সময়ের শিবির নেতা এসএন ইউসুফ এক যুবলীগ নেতার আশীর্বাদে হঠাৎ করে বণে যান যুবলীগ নেতা, যোগ দেন রেলমন্ত্রীর ব্যক্তিগত স্টাফ হিসেবে। মন্ত্রণালয় ও ক্ষমতার অতি নিকটে থাকার সুবাদে তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। অতি অল্প সময়ে ভাগ্য বদলে যায় তার। রাতারাতি গ্রামের বাড়ির টিনের চালাঘর ভেঙ্গে গড়ে তোলেন নজরকাড়া বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স ভবন। ঢাকা ও কুমিল্লায় ফ্ল্যাট, ব্যক্তিগত গাড়ি, গ্রামে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রয়, দুবাইতে খালাতো ভাই লিঙ্কন মজুমদার ও দেশে এক ভগ্নিপতির ব্যবসায় মোটা অংকের পুঁজি বিনিয়োগসহ নামে-বেনামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। এছাড়া ২০২১ সালে চৌদ্দগ্রামের ১৩টি ইউনিয়নে মন্ত্রীকে বুঝিয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের নৌকার টিকিট দেয়ার নামে বাণিজ্য, অসুস্থ্য পিতাকে দেশ-বিদেশে চিকিৎসার নামে রেলের ঠিকাদারদের নিকট থেকে অর্থ আদায়, তার রাজসিক বিয়েসহ বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়ার বিষয়টিকে আলাদিনের চেরাগ বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের দুর্দিনের ত্যাগী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মন্ত্রীর নিকট কানাঘুষাসহ ভুল বুঝিয়ে তাদের দূরে রেখে ২০২২ সাল পর্যন্ত ফায়দা লুটার বিস্তর অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পাতায় ‘শিবির নেতার ভাগ্য বদলেছে যুবলীগ নেতার আশীর্বাদে, সাবেক মন্ত্রীর স্টাফ হয়ে মালিক বনেছেন গাড়ি-বাড়ির’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়। তার নানান অনিয়ম দুর্নীতি ও অর্থলিপ্সার কারণে একপর্যায়ে মুজিবুল হক তাকে অপসারণ করেন। পরবর্তীতে ইউসুফ একটি বেসরকারি ব্যাংকে পিআরও পদে চাকরি বাগিয়ে নেন। আওয়ামী লীগের পতনের পর তার বিরুদ্ধে ওই কিবরিয়া সিন্ডিকেটের সাথে থেকে রেলমন্ত্রণালয়ে নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নানান ফন্দিফিকির করে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে যাওয়ার বিষয়টি বেশ আলোচনায় আছে। সরকার পতনের পর তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
* খোরশেদ আলম প্রকাশ ক্যাসেট আলম: রেলমন্ত্রণালয় সিন্ডিকেটের কিবরিয়ার আরেক সহযোগী খোরশেদ আলম প্রকাশ ক্যাসেট আলম। তিনি মন্ত্রীর চৌদ্দগ্রাম উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা। একসময় স্থানীয় চৌমুহনী বাজারে ক্যাসেট রেকর্ডিং বিক্রি ও মাইকিং ব্যবসা করলেও ১৯৯৮ সালে তৎকালীন হুইপ মুজিবুল হকের কাছে ভিড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি চৌদ্দগ্রামে দলের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। মুজিবুল হকের ক্ষমতার মেয়াদে দীর্ঘসময় থেকে বিশেষ করে কিবরিয়ার সঙ্গে রেলভবনে দাপট খাটিয়ে কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে যান। অনুসন্ধানকালে স্থানীয় সূত্রগুলো জানান, সৌদি আরব ও দুবাইয়ে তার ব্যবসা, ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় ৯/এ-তে চিকিং নামে রেস্টুরেন্ট ও সিভিক ফার্মা নামে পার্টনারশীপ ব্যবসা, ঢাকার পান্থপথ ও ৩০০ফিট এলাকায় ফ্ল্যাট-প্লট, কাওরান বাজারে ভবন নির্মাণ এক্সেসরিজ ব্যবসা এবং কক্সবাজারে মূল্যবান জমিসহ এখন তিনি অঢেল সম্পদের মালিক। সরকার পতনের পর তিনি সৌদি আরবে পলাতক আছেন বলে জানা গেছে।
* খালেদ মাহমুদ চঞ্চল: তিনি চাঁদপুর জেলার বাসিন্দা হলেও মন্ত্রী মুজিবুল হকের প্রভাবে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন, থাকতেন কুমিল্লা ও ঢাকায়। মন্ত্রীর প্রভাবে সওজ, বিএডিসি, পাউবোসহ বিভিন্ন দপ্তরের ঠিকাদারী কাজের নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রেলের কমিশন বাণিজ্যে নিয়োজিত থেকে দেড় যুগেরও বেশি সময়ে কয়েকশত কোটি টাকার মালিক বনে যান। তিনি কুমিল্লা শহরের শাকতলা এলাকায় নির্মাণ করেছেন ৫ তলাবিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি। এছাড়া ঢাকায় রয়েছে তার প্লট-ফ্ল্যাট ও মোটা অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স। সম্প্রতি তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।
* রুপম মজুমদার: রেল সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য রুপম মজুমদার। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার বাইরে হলেও মুজিবুল হকের আশির্বাদে তিনিও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ লাভ করেন। দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস না থাকলেও তিনি কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগরের পাড়ের একটি বহুতল ভবনে দুটি ফ্ল্যাটসহ ঢাকা, কুমিল্লা ও তার শ^শুর বাড়ি এলাকায় নামে-বেনামে একাধিক প্লট-ফ্ল্যাট, কৃষি জমি ও ব্যাংক ব্যালেন্স রয়েছে। ভারতেও তিনি স্বজনদের কাছে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছেন বলেও জনশ্রুতি আছে।
* মোশারেফ হোসেন: এক সময়ের হা-ভাতে পরিবারের মোশারেফ হোসেন জামায়াতের স্থানীয় এক নেতার বিরুদ্ধে মামলা করে মুজিবুল হকের আস্থাভাজন হন। একাডেমিক শিক্ষা না থাকলেও পতিত সরকারের আমলে মুজিবুল হকের আশির্বাদে তিনি চৌদ্দগ্রামের কাশিনগর ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে আর পিছু ফিরে তাঁকাতে হয়নি। রেল সিন্ডিকেটের সদস্য এই ব্যক্তিটি মুজিবুল হকের পরিচয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অফিসে নিয়োগ-তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে গত ১৫ বছরে ঢাকা, কুমিল্লা ও নিজ এলাকায় অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। সরকার পতনের আগমুহুর্তে তিনি অস্ট্রেলিয়া পালিয়ে যান।
এছাড়াও মুজিবুল হকের আরেক ভাতিজা ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন স্বপন, তোফায়েল আহমেদ, শ্যালক নাছির, স্ত্রী হনুফা আক্তার রিক্তা, রুপম মজুমদার, খালেদ মাহমুদ চঞ্চল, আবুল বশর ও বেশ কয়েকজনসহ বিশ^স্ত নিকটাত্মীয়ের নিকট নগদ ও ব্যাংক হিসাবে সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের কয়েক হাজার কোটি টাকা জমা রয়েছে বলে ঢাকা, কুমিল্লা ও চৌদ্দগ্রামে দলের নেতাকর্মীসহ সচেতন মানুষের মধ্যে বেশ গুঞ্জন রয়েছে। এদের মধ্যে চৌদ্দগ্রামের আমানগন্ডা গ্রামের আবুল বশর নামের এক গৃহকর্মী প্রায় ৩ বছর আগে মুজিবুল হকের গচ্ছিত প্রায় ৫০ কোটি টাকা নিয়ে দুবাই পাড়ি জমানোর বিষয়টি তৎসময়ে এলাকায় বেশ আলোচিত ছিল। এছাড়া মন্ত্রীর শ^শুর বাড়ি চান্দিনার মিরাখোলা এলাকায় স্ত্রী-শ^াশুরি-শ্যালকদের নামে কৃষি জমি ক্রয়ের খবরও মিলেছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য জানা যায়নি।
‘আমার কাক্কা ক্যাবিনেট মিনিস্টার’
কয়েকশত কোটি টাকার মালিক মুজিবুল হকের সেই ভাতিজা তোফায়েল এখন পলাতক
শীর্ষ সংবাদ: