ডা. শাহাদাত হোসেন
৫ আগস্ট থেকে চসিকের (চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন) মেয়র ছিল না। পরে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার। মেয়র না থাকায় পুরো তিনমাসজুড়ে বড় প্রকল্প ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং রাস্তাঘাট মেরামত কাজ স্থবির হয়ে পড়ে। চট্টগ্রামে ফুটপাত দখল এবং কর্পোরেশনের আওতাধীন হাসপাতালগুলোতে তৈরি হয় নানা রকমের অব্যবস্থাপনা। ফলে সকলের মুখে ছিল একজন মেয়র এলে সব ঠিক হবে। সেই আক্ষেপের ইতি টেনেছেন ডা. শাহাদাত হোসেন।
শপথ নিয়ে চট্টগ্রামে ফিরে বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। বলেন, নগর পিতা নন, নগর সেবক হতে চাই। একইসঙ্গে চসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, কাজে না দেখলে চাকরিও থাকবে না। পাশাপাশি করপোরেশনের ওয়ার্কিং ওয়ারে যেন কেউ রাজনৈতিক আলাপ নিয়ে না আসে এজন্য নেতাকর্মীদেরও স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন নতুন মেয়র। এসব বক্তব্য নিয়ে আশাবাদী নগরীর বাসিন্দারা। জনতার মেয়র হিসেবেই শাহাদাত নগরীকে সত্যিকার অর্থে সাজিয়ে তুলবেন, এমনই প্রত্যাশা সকলের।
৫ আগস্ট পরবর্তী ক্ষমতার পটপরিবর্তনে দেশের ১১টি সিটি করপোরেশন এখনও মেয়রবিহীন থাকলেও ব্যতিক্রম হল চট্টগ্রাম। নির্বাচনের সাড়ে তিন বছর পর আদালতের রায়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে গত রবিবার শপথ নেন বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখেন ডা. শাহাদাত। তৃণমূল পর্যায় থেকে ধারাবাহিকভাবে দল করে গড়ে ওঠা এ নেতা জনপ্রতিনিধির আসনে বসায় আপ্লুত দলের কর্মীরা। একইসঙ্গে নগরীর বাসিন্দারাও বলছেন, একজন শিক্ষিত; জনপ্রিয় চিকিৎসক মেয়র পদে আসীন হয়েছেন, এ মূল্যায়নের প্রতিদান তিনি সর্বোচ্চ দেবেন। মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন ডা. শাহাদাত। তিনি সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি ও আহ্বায়ক থাকাকালীণ সময়ে নগর বিএনপির রাজনীতিতে তৃণমূল কর্মীদের নিয়ে সভা-সমাবেশে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়, যার প্রমাণ মেলে মঙ্গলবার সকালে।
মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণের পর চট্টগ্রামে ফিরে বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছেন, তিনি নগর পিতা নন, নগর সেবক হতে চান। মঙ্গলবার বেলা পৌনে একটায় ঢাকা থেকে ট্রেনে নগরীর পুরাতন রেল স্টেশনে এসে পৌঁছান নতুন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। কিন্তু তার আগেই বেলা ১১টা থেকে নতুন ও পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন এলাকা হাজার হাজার বিএনপির নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে সরব হয়ে ওঠে। সেখানে বিএনপি আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমি এ শহরের ৭০ লাখ মানুষের নগর পিতা নয়, সেবক হতে চাই। এই শহরে সকল ধর্মের, জাতির, বর্ণের, মানুষের পাশে থেকে নগর সেবক হিসেবে কাজ করে যেতে চাই। এজন্য সবার সহযোগিতা চাই।
দলের নেতাকর্মী সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তিনি আরও বলেন, আমি নেতাকর্মীদের কাছে চিরঋণী। আপনাদের প্রতি আমার যে ঋণ তা কীভাবে শোধ করব জানি না। দলের ৪৩টি ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা গত ১৮ বছরে ঘরে থাকতে পারেননি। আপনাদের পাশে কেউ ছিল না। আপনাদের অসহায়ত্ব আমি দেখেছি। সারাদেশে ৬শ এর অধিক গুম হয়েছে। মানুষ অসংখ্য মামলা নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। ১ লাখ মামলায় ৬০ লাখ আসামি হয়েছে, তবু কেউ বিএনপির আদর্শ ছাড়েনি।
পেশাজীবীদের ধন্যবাদ দিয়ে ডা. শাহাদাত বলেন, সাংবাদিকরা আইসিটি মামলার বিরুদ্ধে গিয়েও বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া হামলা-মামলার তথ্য তুলে ধরেছেন। আমি আপনাদেরই সন্তান। এ শহর আমার একার নয়। ৭০ লাখ মানুষের। আসুন সবাই মিলে এ শহরকে ক্লিন সিটি, গ্রিন সিটি, হেলথি সিটি হিসেবে গড়ে তুলব। আমাকে একটু সময় দিন, আমি কথা দিয়েছিলাম। সেই ওয়াদা আমি অক্ষরে অক্ষরে আমি তা পালন করব।
অপরদিকে নতুন মেয়র তার দলের নেতাদের প্রতিও ধন্যবাদ জানান। তিনি তার বক্তব্যে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাউদ্দিন আহমদ, আবদুল্লাহ আল নোমান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন চৌধুরীসহ সকল নেতাদের কথা উল্লেখ করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
বিকালে নতুন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন লালদীঘি পাড় এলাকার করপোরেশনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেখানে মেয়রকে চসিকের আয়-ব্যয় এবং সমস্যা ও বর্তমান ৪১ ওয়ার্ডের পরিস্থিতি সর্ম্পকে ধারণা দেন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
সার্বিক বিষয়ে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদের জানান, এমন সময় আমি দায়িত্ব নিয়েছি যখন দেশে একটি ক্রান্তিকাল পালন করছে। ৭১ সালে মা-বোনের ইজ্জাত ও শহীদের রক্ত দিয়ে দেশে স্বাধীন হয়েছে। এদেশে মানবতা, সাম্যতা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আমরা বারবার গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পথে হোঁচট খেয়েছি। স্পষ্ট বলতে চাই, ভৌগালিক দৃষ্টি কোণ থেকে চট্টগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে এ স্লোগান দিয়েই কাজ শুরু করছি। নতুন প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য সুন্দর, পরিচ্ছন্ন গ্রিন, ক্লিন সিটি গড়ে তুলব। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আমার সঙ্গে কাজ করবেন। কাজের প্রতি মমত্ববোধ থাকতে হবে, কাজের দায়বদ্ধতা থাকতে হবে, তাহলেই কাজ আন্তরিকভাবে সম্পন্ন হবে।
আমি এসি রুমে বসে থাকার লোক নয় উল্লেখ করে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ৪১ ওয়ার্ডে আমি প্রোগ্রাম করব। আমাদেরকে প্রধান কাজ করতে হবে, ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে। এ জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান, মশক নিধন স্প্রে ও লিফলেট বিতরণ হবে। এমন কোনো স্প্রে চাই না যেটা দিয়ে মশা মরে না। মশা নিধন হয় এমন ওষুধ চাই না। এসব ওষুধ আমি করপোরেশনে গ্রহণ করব না। আমি করপোরেশনে বেশিক্ষণ থাকব না, সকালেই অফিসে এসে এখানের কাজ শেষে দ্রুত বের হয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে যাব। প্রায় দুই হাজার কর্মচারী পরিচ্ছন্নতা অভিযানে থাকবে। যদি কাউকে আমি না দেখি ওয়ার্ডে , তাহলে তাদের চাকরি নাও থাকতে পারে।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট সর্তকতা বার্তা দিয়ে মেয়র বলেন, ৯ টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কোনো ধরনের রাজনৈতিক আলোচনা নিয়ে করপারেশনে আসবেন না। আমি এ সময়ে করপোরেশনের কাজে থাকব। ৫টার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। নিজের আত্মশুদ্ধি হলে সব কিছু পরিবর্তন হবে।
চট্টগ্রামের সকল সেবা সংস্থার সমন্বয়ই প্রয়োজন উল্লেখ করে নতুন মেয়র বলেন, এজন্য প্রয়োজন সিটি গর্ভমেন্ট। নগর সরকার হলেই সমন্বয় হয়। হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন আমি সব জানি, কারণ আমার ব্যবসা আছে, বাড়ি আছে, বেসরকারি হাসপাতাল আছে। হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর দরকার নাই, যা হোল্ডিং ট্যাক্স আছে তা আদায় করলেই হবে। অতএব এখানে কি হয় আমি জানি। মাঝখানে একটি গ্রুপ কিছু টাকা নেওয়ার কথা বলে সিটি করপোরেশনকে অর্থনৈতিকভাবে দৈউলিয়া করার চেষ্টা করে, এসব করবেন না। আপনারা বেতন পাচ্ছেন। সিটি করপোরেশনকে সাবলম্বী করতে পারলে বছরে দুটি বোনাসও পাবেন।
চট্টগ্রাম নিয়ে অনেক কিছু করার আছে উল্লেখ করে ডা. শাহাদাত বলেন, বাচ্চাদের জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছে আছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ৪১টি খেলার মাঠ করার ইচ্ছে রয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুদিন ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, একসময় মেমন হাসপাতালে অনেক রোগী দেখতাম। এখন ওই অবস্থায় নাই। আমি সেই আগের জায়গায় মেমন হাসপাতাল দেখতে চাই। আরবান হাসপাতালগুলো একটিভ করতে চাই। প্রয়োজনে সেখানে ছোট্ট ছোট্ট অপারেশন থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করা হোক।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় সিটি করপোরেশনের টাকা দিয়ে কেনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজের নামে করে ফেলা হচ্ছে এসব পরিহার করতে হবে। চসিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫১ থেকে ৫২ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়। ১৬ বছরে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে মান বৃদ্ধি পায় নাই। চসিকের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে। এটি হলে পারলে আলোকিত সমাজ উপহার দিতে পারব।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে হটলাইন চালু এবং যাতে দ্রুত সেবা পায় এজন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কর্ণার করার কথা জানান নতুন মেয়র। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অবশ্যই গঠনমূলক সমালোচনা করবেন। আমার মাত্র দেড় বছর সময় আছে। আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে আমি এ পদে এসেছি। ইভিএমের প্রিন্টেট কপি দেইনি তারা, হাতে লিখে আমার ভোট কমিয়ে দিয়েছিল। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠান হয়েছে।
ফুটপাত দখল নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ট্রাফিক, পুলিশ, শ্রমিক সংগঠন সবগুলোর সঙ্গে বসে একটার পর একটা সমাধান করব। আইন আছে, অবশ্যই সমাধান করব। অল্প সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সমাধান করব। এখন ডেঙ্গু হল গুরুত্বপূর্ণ, কেউ যাতে ডেঙ্গুর চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয় এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত না হয় একাজগুলো করতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে আমি লোক দেখানো ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে চাই না। রাজশাহীতেও দেখেছি, রাতে পরিষ্কার করা হয় শহর। চট্টগ্রাম শহরকে পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলোর দ্বন্দ্বের ইতিহাস টেনে বলেন, সাবেক মেয়র আ জম নাছির ও চউকের সাবেক চেয়ারম্যান ছালামের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। এজন্য চসিক ও চউকের মধ্যে সমন্বয় ছিল না। অনতিবিলম্বে জলাবদ্ধতা প্রকল্প বিষয়ে জনসম্মুখে কথা বলব চউককে সঙ্গে নিয়ে। একইসঙ্গে দুর্নীতির দমন কমিশনে চসিকের যেসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন নতুন মেয়র।
শিহাব উদ্দিন