প্রতীকী ছবি
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ার পর আওয়ামী সরকারের গত দেড় দশকে নিয়োগ ও পদোন্নতি পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্য সদস্যদের রাজনৈতিক আমলনামা, কর্মকা- খতিয়ে দেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি), মন্ত্রী বা সচিব ডিও লেটার (চাহিদাপত্র) দিয়েছেন, অর্থাৎ কার সুপারিশ ছিল তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এমনকি যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তদবিরে যাদের পদোন্নতি হয়েছে, তাদেরও শনাক্ত করার চেষ্টা করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। পাশাপাশি যারা সুবিধা নিয়েছেন তাদের তালিকা তৈরির কাজও গুছিয়ে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বেশি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের এক নির্দেশনায় অনুযায়ী এই আমলনামা তৈরি করা হচ্ছে এবং আগামী এক মাসের মধ্যে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
গত দেড় দশকে পুলিশে নতুন পদ সৃষ্টি হয়েছে ৮৩ হাজার। আর নিয়োগ হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজারের মতো। নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে উপপরিদর্শক (এসআই) ও কনস্টেবল বেশি। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের এ নিয়োগের বড় অংশই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে মূলত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে।
কোটা সংস্কার নিয়ে গত জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার পর তা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। এর জের ধরে গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। আন্দোলন ঠেকাতে তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক দমনপীড়ন চালায়। বৈষম্যবিরোধী স্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির হিসাবে শিক্ষার্থী ও নিরীহ লোকজন, পুলিশ, আনসারসহ ১ হাজার ৫৮১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ৭০৮ জন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো আন্দোলন ঘিরে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা এই প্রথম। গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। পুলিশের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাও আত্মগোপনে চলে যান। আন্দোলন দমনে পুলিশে ভূমিকা ব্যাপক সমালোচিত হয়। বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশের রাজনৈতিক পরিচয় খতিয়ে দেখার দাবি ওঠে। এর জের ধরে ইতিমধ্যে পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে পুলিশে যারা চাকরি পেয়েছেন, তাদের আমলনামা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ শাখাসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে কাজটি করছে।
২০০৭ সালের এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পরের বছর ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১১টি বিএসএস পরীক্ষায় মোট ১ হাজার ৩৮৩ জন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) নিয়োগ ও নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এর বাইরে এসআই, সার্জেন্ট ও কনস্টেবল পদেও বড় নিয়োগ হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে পুলিশের ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিষয়ে গোপন তদন্ত পরিচালনা করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এসআই পদে নিয়োগ পাওয়াদের বিষয়েও অনুসন্ধান করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২৮, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৪০ ও ৪১তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীদের নির্দিষ্ট একটি অংশের নাম উল্লেখ করে আবারও তাদের প্রাক-চাকরি বৃত্তান্ত যাচাইয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয় গত ২০ অক্টোবর। ওই নির্দেশনায় যেসব বিষয় অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে নাম, জন্মতারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, সচল এবং একাধিক মোবাইল ফোন নম্বর, ইমেইল ও ফেসবুক আইডি, ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর-টিআইএন (যদি থাকে), পাসপোর্ট নম্বর (যদি থাকে) উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। তাছাড়া তারা কোন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিয়ে থাকেন, তাও খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে। তাছাড়া উচ্চাভিলাষী ও অপেশাদার পুলিশ সদস্যদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে বিসিএসের ১২, ১৫, ১৭, ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৪, ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাই বেশি। তাছাড়া সাবেক কয়েকজন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও পুলিশ কমিশনারের নামও আছে তালিকায়।
পুলিশের আরেকটি সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে ২৮তম বিসিএসে এএসপি পদে ১৮০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই সময় থেকে পুলিশে রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগ শুরু হয়। ২০১৭ সালে ৩৫তম বিসিএসে নিয়োগ দেওয়া হয় ১১৪ জনকে। ২০১৮ সালে ৩৬তম বিসিএসে নিয়োগ দেওয়া হয় ১১৫ জনকে ও ২০১৯ সালে ৩৭তম বিসিএসে নিয়োগ দেওয়া হয় ৯৭ জনকে। ২০২২ সালের ১ নভেম্বর ৪০তম বিসিএসে ৭১ জন এএসপি নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ৬২ জনই ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে ওই ব্যাচের শিক্ষানবিশ এএসপিদের সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়। ২০২৩ সালে ৪১তম বিসিএসে এএসপি পদে ১০০ জনের নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। তাদেরও বড় একটি অংশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১১ সালে ২৯তম বিসিএসে ৩৫, ২০১২ সালে ৩০তম বিসিএসে ১৮৪, ২০১৩ সালে ৩১তম বিসিএসে ১৮৪, ২০১৪ সালে ৩৩তম বিসিএসে ১৫৫ ও ২০১৬ সালে ৩৪তম বিসিএসে ১৪৮ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালের ৪০তম ব্যাচের শিক্ষানবিশ এসআইদের মধ্যে ৮২৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই ব্যাচের ৯৩ জন অমুসলিমসহ ২৫২ জনকে ইতিমধ্যে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আর ৫৯ জনকে শোকজ করা হয়েছে। তাদের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে দলীয় বিবেচনায় পুলিশে ব্যাপক নিয়োগ হয়েছে। পদোন্নতি ও ভালো জায়গায় পদায়নে তদবির হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের পাশাপাশি তালিকা করে স্বরাষ্ট্র সচিবও পুলিশপ্রধান ও জেলার এসপিদের কাছে তদবির করেছেন। তাদের চিহ্নিত করা হবে। ছাত্রজীবনে যারা ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তারাই বেশি বেপরোয়া ছিল।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশ সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরসহ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আন্দোলনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে যারা জড়িত ছিল তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া প্রায় শেষ করে এনেছে। প্রাথমিকভাবে ওইসব কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর পুলিশ সদর দপ্তরের পিআইএমএস (কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত তথ্যভা-ার) হ্যাক হয়েছিল। সেখানে কর্মকর্তাদের বাসা-বাড়ির ঠিকানা ও ব্যক্তিগত তথ্য ছিল। প্রথমে এসব তথ্য না পেলেও মাসখানেক আগে তা পাওয়া যায়। এরই মধ্যে শতাধিক কর্মকর্তার কর্মকা- নজরদারি করা হচ্ছে।
পুলিশের অন্য একটি সূত্র জানায়, পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকটি ব্যাচ নিয়ে গোপন তদন্ত শুরু হয়েছে। নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্যদের বিষয়েও চলছে একাধিক গোপন তদন্ত। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এ তদন্ত পরিচালনা করা হচ্ছে। তাদের অতীত কর্মকা-, যে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন তার নাম, সেশন ও অধ্যয়নের বিষয় এবং অবস্থান বা আবাসিক হলের নাম, ওই সময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্য অন্য জেলায় অধ্যয়ন করে থাকলে সংশ্লিষ্ট জেলায় যোগাযোগ করে তার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন করে বন্ধুর নাম, ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট থানার রেকর্ড (সিডিএমএসের তথ্য) যাচাই করতে বলা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বা সদস্যের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা (যদি থাকে) ও কোনোরূপ জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় আছে কি না, তা যাচাই করতে বলা হয়েছে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, গ্রহণযোগ্যতা আছে এমন জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক এবং তার সমসাময়িক স্কুল বা কলেজ জীবনের সহপাঠীদের ধারণা বা মন্তব্য যাচাই করতে বলা হয়েছে। পরিবার বা নিকটাত্মীয়, স্বজনের নাম ও পদবিসহ পেশার বিবরণও উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উচ্চাভিলাষী অপেশাদার কিছু পুলিশ কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে পুলিশের বিভিন্ন আইন ও প্রবিধান লঙ্ঘন করে আন্দোলনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেন।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা এখনো চলছে। তারা রাজনৈতিক বলয় থেকে বের হতে নানাভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। সব রাজনৈতিক দল পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে ফায়দা নেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবার সময় এসেছে ‘একটু ঘুরে দাঁড়াতে’। অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে পুলিশ বাহিনী সংস্কার করতে। সংস্কার করতেই হবে। আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। রাজনৈতিক সরকার পুলিশের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। দলীয় বিবেচনায় কাউকে নিয়োগ দিতে পারবে না। তিনি জানান, সংস্কারের অংশ হিসেবে পুলিশের পোশাক ও মনোগ্রাম পরিবর্তন হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা করার চেষ্টা চলছে।
২০০৭ সালে প্রস্তাবিত আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো বাতিল করার জন্য সংস্কার কমিটিকে প্রস্তাব করা হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পুলিশকে রাজনীতিকীকরণই আজকের এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
শিহাব উদ্দিন