ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১

অনেক আসনে শরিকদের ছাড় দেবে

সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি

দীর্ঘদিন ধরে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকা সমমনা দলগুলোকে নিয়েই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এ ছাড়া নির্বাচনের পর তাদের নিয়েই সরকার গঠন করতে চায় দলটি। তবে নির্বাচন ও সরকার গঠনে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল নিয়েছে। 
নভেম্বরের প্রথম দিন থেকেই সারাদেশের সকল জেলা ও মহানগরে ১০ দিনব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই এই গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করবে দলটি। ইতোমধ্যেই দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সকল মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে গণসংযোগ কর্মসূচি সফল করতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রের নির্দেশনা পেয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে কর্মসূচি সফলের প্রস্তুতিও নিয়েছেন তারা। 
এদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩০০ সংসদীয় আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে। নির্বাচনের আগে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা যেন দলীয় কর্মকা-ে অধিকতর সক্রিয় হয় তারই অংশ হিসেবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মাঝেমধ্যে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিটি সংসদীয় এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। শীঘ্রই সকল আসনে দলের প্রার্থীও ঠিক করা হবে বলে জানা যায়। 
দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ভোটের মাঠে সক্রিয় হচ্ছে। তবে দীর্ঘদিন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোকেও কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আগেভাগেই সমমনা ৫টি দলের  ৬ নেতাকে ৬টি আসন ছেড়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই এই ৬ নেতাকে চিঠি দিয়ে নিজ নিজ সংসদীয় আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছে বিএনপি।

এই ৬ নেতা হলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণ সংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা। এই ৬ নেতাকে সার্বিক সহযোগিতা করতে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীদেরও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২২ অক্টোবর বিএনপির মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ কথা জানানো হয়।
বিএনপি ইতোমধ্যেই সমমনা দলের যে ৬ নেতাকে চিঠি দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছে তাদের মধ্যে  জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে বগুড়া-২ আসন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিকে ঢাকা-১২, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূরকে পটুয়াখালী-৩, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানকে ঝিনাইদহ-২ এবং জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদাকে কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়াও গণফোরাম সভাপতি মোস্তফা মোহসিন মন্টুকে কেরানীগঞ্জ অথবা পুরান ঢাকার ১টি আসন এলডিপির (একাংশ) সভাপতি শাহাদাত হোসেন সেলিমকে মৌখিকভাবে লক্ষ্মীপুর-১ এবং কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন এলডিপির আরেক অংশ বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করলে চট্টগ্রামের একটি ও কুমিল্লার ১টিসহ এ দলটিকে ক’টি আসন ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। 
সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার সকল সংস্কার কাজ শেষ করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে চাইলেও বিএনপি এখন তাড়াতাড়ি নির্বাচন করার তাগিদ দিচ্ছে। যতবারই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি নেতারা সাক্ষাৎ করেছেন ততবারই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানেিয়ছেন। বিএনপি চায় দ্রুত সংস্কার কাজ শেষ করে যেন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা হয়। 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর দেশের মানুষের প্রধান দাবি নির্বাচন। কারণ, গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। তাই তারা ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। আমরাও চাই দ্রুত নির্বাচনী সংস্কার কাজ শেষ করে সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। সে নির্বাচনে দেশের মানুষ যাকে খুশি ভোট দিয়ে জনগণের সংসদ ও সরকার গঠন করবে। সে নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার বাস্তবায়ন করবে। তিনি জানান, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, তাই নির্বাচনের প্রস্তুতি বিএনপির সব সময়ই থাকে। 
সূত্র মতে, জোটগতভাবে হোক আর যেভাবেই হোক বিএনপি এবার সমমনা দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচন করবে। ইতোমধ্যেই সমমনা ৫টি দলকে ৬টি আসন ছাড়ার ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে আরও আসন ছাড়বে বিএনপি। সমমনা দলগুলোকে সর্বোচ্চ ২৫টি আসন ছাড়ার প্রস্তুতি রয়েছে বিএনপির। তবে এবার জামায়াত বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করতে চাইলেও তাতে রাজি হবে না দলটি। কারণ, জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে বিএনপির ওপর দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের চাপ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। 
অভিজ্ঞ মহলের মতে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগের পর দলের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী এখন আত্মগোপনে। আরও অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি। এ পরিস্থিতিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠ বিএনপির জন্য খুবই অনুকূল। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যা ঘরিষ্ঠতা পাবে। এ ছাড়া বিএনপি যে সব আসনে সমমনা দলগুলোকে সমর্থন দেয় সেখানে সমমনাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।

তাই নির্বাচনে বিজয়ের পর  সমমনা দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া পূর্বঘোষণা অনুসারে বিএনপি ৩১ দফা সংস্কারের আলোকে নির্বাচনের পর সংসদে উচ্চ কক্ষ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, একই ব্যক্তির দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়াসহ বেশকিছু পরিবর্তন আসবে। 
উল্লেখ্য, অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ে বিএনপি সরকার। এর পর দীর্ঘ দেড় যুগ ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত পরাজিত হয়। এর পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে। তাই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি।

তবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অধীনে নির্বাচন করে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে বিএনপি। তবে ওই নির্বাচনে দিনের ভোট আগের দিন রাতেই হয়ে যায় বলে বিএনপি অভিযোগ করে। আর সর্বশেষ এ বছর ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। বিএনপিবিহীন এ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে চরম বেকায়দায় পড়ে আওয়ামী লীগ।

এ নির্বাচনের পর বিএনপি সমমনা দলগুলোকে নিয়ে নতুন উদ্যমে আন্দোলন শুরু করে। আর সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপে আওয়ামী লীগ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় বলে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো মনে করে। আর এ জন্যই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

×