ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ॥ গা ঢাকা দিয়েছে হামলাকারীরা

অবৈধ অস্ত্রধারীদের অনেকেই চিহ্নিত হলেও অধরা

ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

অবৈধ অস্ত্রধারীদের অনেকেই চিহ্নিত হলেও অধরা

অবৈধ অস্ত্রধারীদের অনেকেই চিহ্নিত হলেও অধরা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ছোড়া গুলিতে আন্দোলনকারীসহ সাধারণ মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়াও ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায় হেলমেট পরিহিত একদল অস্ত্রধারী। এদের অনেকেই ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে। ছাত্র-জনতা হত্যায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। কিন্তু ঘটনার দুই মাসের বেশি পেরোলেও অস্ত্রধারীদের অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণকারী অনেককে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে অবৈধ অস্ত্রের জোগানদাতা সম্পর্কে জানা হচ্ছে। বাকিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তবে সরকার পতনের পরপরই এদের অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে। প্রযুক্তি ও সোর্সের মাধ্যমে জড়িতদের অবস্থান শনাক্তপূর্বক গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।    
ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায় ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে গুলি করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের গুলিতে হতাহতের সংখ্যাও কম নয়। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, জামালপুর, সিলেট, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সেসব সন্ত্রাসীর অস্ত্রসহ ছবি ও ভিডিও তখনই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, প্রকাশিত হয় দেশের গণমাধ্যমগুলোতেও। 
গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে। সে সময় পিস্তল হাতে এক যুবককে আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি গুলি করতে দেখা যায়। ঢাবির শহীদুল্লাহ হলের সামনে ওই ঘটনা ঘটে। অস্ত্রধারীর নাম হাসান মোল্লা। সে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এবং ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী। সে একাধারে পানি উন্নয়ন বোর্ড, গৃহায়ণ ও গণপূর্তের ঠিকাদার। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ। হাসানের চাচা মোল্লা আবু কাওসার ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি। ক্যাসিনোকা-ে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ঢাবি ক্যাম্পাস ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্র হাতে গুলি করতে দেখা যায় নিউমার্কেট, সায়েন্সল্যাব ও জিগাতলা এলাকায়। যদিও ডিএমপি রমনা বিভাগের পুলিশের দাবি, এখন পর্যন্ত কাউকেই শনাক্ত করতে পারেননি তারা। তবে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে। রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. সারোয়ার জাহান বলেন, সম্প্রতি এই ডিভিশনের দায়িত্ব পেয়েছি। এ এলাকায় যারা গুলি চালিয়েছিল, তাদের শনাক্ত করতে কাজ করছি।
গত ২ আগস্ট জুমার নামাজের পর রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর উত্তরা। পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের টানা সংঘর্ষ হয়। সেখানেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি অন্তত তিন বহিরাগত সাধারণ পোশাকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। তাদের মাথায় ছিল হেলমেট। মাইলস্টোন কলেজের সামনে ওই ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানান, অস্ত্রধারীরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ওই তিনজনের ছবিও প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে একজন লাল হেলমেট ও কালো টিশার্ট পরা ছিল। সিলভার কালারের পিস্তল হাতে গুলি করতে দেখা যায় তাকে। ওপর থেকে তোলা ছবিতে তার চেহারা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার নাম হাফিজ উর রহমান। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-মানবাধিকার সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া মুখে দাড়ি, কালো টিশার্ট ও জিন্স পরিহিত যুবককে শটগান থেকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। আরেকজন কালো হেলমেট ও সাদা ফুলহাতা শার্ট পরা ছিল।
আন্দোলনে রাজধানীর যেসব এলাকায় হতাহতের সংখ্যা বেশি, তার মধ্যে মোহাম্মদপুর অন্যতম। দফায় দফায় চলা সংঘর্ষে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাতিজা এবং কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ, সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব, জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদুর রহমান বিপ্লবসহ অন্তত এক ডজন ব্যক্তিকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা যায়।
এক ভিডিওতে দেখা যায়, সাবেক এমপি এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদুর রহমান বিপ্লব গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাচ্ছে আন্দোলনকারীদের দিকে। সঙ্গে ছিল আরও একজন। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি।
অন্যদিকে, বসিলায় লাট মিয়ার ছেলে জামাল বাসার ভেতর থেকে মিছিলে গুলি ছোড়ে বলে জানান স্থানীয়রা। গত ৪ আগস্ট ওই গুলিতে একাধিক ব্যক্তি আহত হন। পরে বিক্ষুব্ধরা বাসাটিতে আগুন ধরিয়ে দেন। 
একই দিন মোহাম্মদপুরে ধারণ করা আরেকটি ভিডিও রয়েছে। 
সেখানে দেখা যায়, হেলমেট পরিহিত দুই যুবক ফুটপাত ধরে ধীরপায়ে এগোচ্ছে। আন্দোলনকারীদের অবস্থান ছিল সেখান থেকে কয়েক গজ সামনে একটি গলির মুখে। ওই দুই যুবক গলির কাছাকাছি গিয়ে একেবারে সামনে থেকে অন্তত পাঁচ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে কয়েকজন সঙ্গে সঙ্গেই লুটিয়ে পড়ে। 
এদিকে বেনাপোল দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি নাঈমুল হাসান রাসেলকে আটক করেছে র‌্যাব। তাকে মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মোহাম্মদপুরে গুলি ও সংঘর্ষে রাসেলের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে দাবি করেছে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান। তিনি বলেন, আসামি রিমান্ডে আছে। তাকে অস্ত্রধারীদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
গত ৪ আগস্ট পাবনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান দুই শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে গুলিবর্ষণে জড়িত নাসির নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গত ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনার দিন পাবনা শহরের ট্রাফিক মোড়ে অস্ত্র হাতে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ভাঁড়ারা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আবু সাঈদ এবং নাসিরকে গুলি করতে দেখা যায়। 
র‌্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো অনেককে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও সে সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি বিশ্লেষণ করে অনেককে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদেরও গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান রয়েছে। তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর চালানো অস্ত্র-গুলি অবৈধ। এসব অবৈধ অস্ত্র তারা কোথায় পেয়েছে, সেসব বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অস্ত্রের জোগানদাতা, হত্যার ইন্ধনদাতাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। 
গত ১৫ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত সিলেট শহরে পিস্তল, শটগান ও রাইফেল হাতে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী। স্থানীয়দের দাবি, যেসব অস্ত্রধারীর ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গত ১৬ জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত চার যুবককে গুলি করা হয়। তাদের একজনের হাতে ছিল একে-৪৭-এর মতো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রও। 
অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাসিব আজিজ। তিনি বলেন, এই সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।  
তবে পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, এসব সন্ত্রাসীকে শনাক্ত করার পাশাপাশি আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। চলমান অভিযানে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলেও অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের খবর নেহাত কমই।

×