ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

শাহরিয়ার আলমের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক

ভূমিহীন থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২৩:০১, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ভূমিহীন থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক

শাহরিয়ার আলম

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ১৫ বছর আগে ছিলেন ভূমিহীন, এখন কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের জমা দেওয়া হিসাব অনুযায়ী ভূমিহীন ছিলেন শাহরিয়ার আলম। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। গত ১৫ বছরেই আলাদিনের চেরাগ পেয়ে তর তর করে ধনসম্পদ, জমি-জমা বেড়ে গেছে তার।

আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি ও প্রতিমন্ত্রী হয়েই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন শাহরিয়ার আলম। রাশিয়া, ব্রাজিল ও চীনে খুলেছেন নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দেশে গড়ে তুলেছেন আটটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। এত দ্রুত কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার বিষয়টি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের বিস্ময়ে চোখ কপালে ঠেকেছে। এ বিষয়ে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ২০২২ সালে চারঘাট সদরে উপজেলা ভূমি অফিসের পূর্বপাশে বিশ্বনাথ রমেকা নামে এক ব্যক্তির কাছে থেকে ৩৩ শতাংশ জমি কেনেন। এ ছাড়াও বাঘা, লালপুর ও ঈশ্বরদীতে নামে-বেনামে আরও জমি কিনেছেন তিনি। অথচ শাহরিয়ার আলমের ২০০৮ সালের হলফনামায় দেওয়া তথ্যে তার কোনো জমি ছিল না। আর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল সব মিলিয়ে দুই কোটি তিন লাখ ২০ হাজার টাকার।

পোশাক কারখানার নামে ঋণ ছিল ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪২২ টাকা। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে নিজের নামে কৃষি ও অকৃষি জমি দেখিয়েছেন ৫১ বিঘা। অস্থাবর সম্পদ দেখান ৮৯ কোটি ২৪ লাখ ৯ হাজার ৯৭৩ টাকার। আর নিজের পোশাক কারখানার নামে থাকা ৭৬ কোটি টাকার ঋণও পরিশোধ দেখান। অর্থাৎ এই সময়ে তিনি অন্তত ১৬৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০০৮ সালে তার নামমাত্র গার্মেন্ট ছিল। আর বর্তমানে তার মালিকানাধীন গার্মেন্টসের সংখ্যা আটটি।

আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি ও প্রতিমন্ত্রী হয়ে ১৫ বছরেই তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও গড়েছেন সম্পদ। রাশিয়া, ব্রাজিল ও চীনে খুলেছেন নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গড়েছেন আটটি পোশাক কারখানা। নিয়েছেন নিজের রেনেসাঁ গ্রুপের নামে ‘দুরন্ত’ টেলিভিশন। রাজশাহীতে গড়ে তুলেছেন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

এ ছাড়াও ঢাকার গুলশানে নিজের নামে দুটি, পুত্রের নামে একটি এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে নিয়েছেন তিন হাজার ৬০০ বর্গফুটের রাজকীয় ফ্ল্যাট। চারঘাটের একমাত্র সিনেমা হল (লিলি সিনেমা হল) ছিল চারঘাট-বাঘা আঞ্চলিক মহাসড়কের মেরামতপুর এলাকায়। ২০১০ সালের পর সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলে হল মালিকরা ভবনসহ জমিটি বিক্রির উদ্যোগ নেন।

২০১৪ সালে শাহরিয়ার আলম প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর সিনেমা হলের জায়গাটি কিনে সেখানে গার্মেন্ট গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। মাত্র ৫০ লাখ টাকায় ৩৩ শতক জমি ও ভবনসহ সিনেমা হল কিনে নেন তিনি। কিন্তু ১০ বছর অতিবাহিত হলেও সেখানে গার্মেন্টের একটি পিলারও ওঠেনি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নর্থ বেঙ্গল এগ্রো ফার্মস লিমিটেড ছাড়াও শাহরিয়ার আলম খামারবাড়ি করেছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চৌধুরীহাট এলাকায়। এমপি হওয়ার পর ২০১০ সালে ২৫ বিঘা জমি কেনেন সেখানে। ২৫ বিঘা জমি কিনলেও প্রভাব খাটিয়ে আরও ১০ বিঘা খাস জমি দখল করেছেন তিনি। সেখানে গড়ে তুলেছেন বাংলো বাড়ি, গরুর খামার, টিস্যু কালচার ল্যাব, বনসাই গবেষণাগার।

এ ছাড়াও লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়ও ২০১৭ সালে ১৩ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে খামারবাড়ি। বিভিন্ন দামি সবজি, মাছসহ নানা ধরনের চাষাবাদ করা হচ্ছে সেখানে। শাহরিয়ার আলমের ছোটবেলা কেটেছে লালমনিরহাট জেলায়। সেই সুবাদেই সেখানে জমি কিনে খামারবাড়ি গড়ে তুলেছেন। তার দীর্ঘদিনের এপিএস সিরাজুল ইসলাম সিরাজের বাড়িও এই কালীগঞ্জে।

শাহরিয়ার আলমের বাবা মো. শামসুদ্দিন ছিলেন পশ্চিমাঞ্চল রেলের কর্মচারী। সেই সুবাদে তাকে থাকতে হয়েছে লালমনিরহাটে।
তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের কাছে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর জমি ও অর্থসম্পদ পাহাড় গড়ে তোলার নেশায় শাহরিয়ার আলম তার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছেন। তিনি তার এপিএস সিরাজুল ইসলামের মাধ্যমে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন টিআর-কাবিখাসহ সরকারি সব অনুদান ও প্রকল্প।

এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগেও করেন বাণিজ্য। চাকরি, বদলিসহ বিভিন্ন কাজেও এপিএসের মাধ্যমে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। প্রতিমন্ত্রীর তহবিলে টাকা না দিলে কারও টিআর-কাবিখা বা সরকারি অনুদান পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আবার টাকা দিলে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও মিলেছে সরকারি বরাদ্দ।
দুদক সূত্র জানান, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের বসন্তপুর মোড়ের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে নর্থ বেঙ্গল এগ্রো ফার্মস লিমিটেড নামের একটি কৃষি খামার। ৫২ বিঘা আয়তনের এই কৃষি খামারের মালিক সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম। এর মধ্যে ১২ বিঘা জমি খাস। ২০২০ সালে সেখানে একই প্লটে ৪০ বিঘা জমি কেনেন তিনি।

জমির মালিক ছিলেন বাঘা উপজেলার বাঘা পেট্রোল পাম্পের মালিক গোলাম মোস্তফা। তার অভিযোগ, জমির মূল্য পরিশোধ না করে শাহরিয়ার আলম প্রতারণার মাধ্যমে দখল নিয়েছেন। একই সঙ্গে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে দখল করেন ১২ বিঘা খাস জমি।
জমির মালিক গোলাম মোস্তফা অভিযোগ করেছেন, ন্যাশনাল ব্যাংক গোদাগাড়ী শাখায় আমার ছয় কোটি টাকা ঋণ ছিল। ঋণ পরিশোধ করতে জমি বিক্রির উদ্যোগ নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক ব্যক্তির সঙ্গে সাড়ে ১১ কোটি টাকা দাম চূড়ান্ত করে বায়নানামাও নেই। এ সময় শাহরিয়ার আলম জানতে পেরে তিনি জমিটা কিনবেন বলে জানান আমাকে। তিনি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে ছয় কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেন এবং আমাকে নগদ ৫০ লাখ টাকা দিয়ে জমিটা রেজিস্ট্রি করে নেন।

কথা ছিল বাকি পাঁচ কোটি কয়েক দিনের মধ্যেই পরিশোধ করবেন। কিন্তু পরে তিনি আর টাকা দেননি। আমার সঙ্গে প্রতারণা করে শুধু ঘোরাতে থাকেন শাহরিয়ার আলম। আওয়ামী লীগের একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রীর দাপটের কাছে পেরে উঠতে পারেননি জমির মালিক গোলাম মোস্তফা।
শাহরিয়ার আলম ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবার আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হন। প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সময় ২০০৮ সালে ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা দামের হোন্ডা সিআরভি মডেলের গাড়িতে এবং স্ত্রী ২৭ লাখ টাকা দামের নিশান এক্স-ট্রায়াল গাড়িতে চড়তেন।

সর্বশেষ তাকে এক কোটি এক লাখ তিন হাজার ১০০ টাকা দামের লাক্সারি গাড়িতে এবং তার স্ত্রীকে এক কোটি ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৫৭৫ টাকা দামের গাড়িতে চড়তে দেখা যায়। নাটোরের লালপুরে শাহরিয়ার আলমের দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়ি। সেখানকার স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার কন্যা সিলভিয়া পারভীন লেনিকে দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রথম স্ত্রী আয়েশা আক্তার ডালিয়াকে তালাক দেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় স্ত্রী লেনির মা রোকসানা মর্ত্তুজা লিলিকে ২০২১ সালে শাহরিয়ার আলম প্রভাব খাটিয়ে মেয়র বানান। লালপুরে স্ত্রীকে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি করে দিয়েছেন শাহরিয়ার আলম।
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করছে দুদক। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। দ্বাদশ সংসদের নির্বাচনী হলফনামায় তাদের সম্পদ বেড়েছে ৫৫ গুণ পর্যন্ত। ১৯৯৫ সালে পোশাক শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। ২০০৮ সালে তার ঋণ ৭৬ কোটি আর অস্থাবর সম্পদ ছিল ৩ কোটি টাকা।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় ২০২৪ সালে তার কোনো ঋণ ছিল না। সম্পদ বেড়েছে ৫৫ গুণ। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন কাজ নেওয়া এবং নিজের কোম্পানিতে চাকরিরত ভারতীয়দের হুন্ডির মাধ্যমে বেতন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বর্তমান অবস্থান কোথায় তা জানতে গিয়ে খোঁজ পেয়েছেন, গত ৪ আগস্ট বিকেলেও শাহরিয়ার আলম বাঘা উপজেলার আড়ানীর বাসায় ছিলেন। সন্ধ্যার পর থেকে আর কোনো নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি তিনি। নিজের গাড়ি ঢাকায় পাঠিয়ে তিনি ৫ আগস্ট ভোরে বাঘার আরেক নেতার গাড়িতে চড়ে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে গেদে বর্ডারে পৌঁছেন। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে এখন রাশিয়ায় অবস্থান করছেন শাহরিয়ার আলম।

×