ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

স্পর্শকাতর স্থাপনায় হামলার লক্ষ্য ছিল

সরকার পতন!

ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ২৩:৪৫, ২৪ জুলাই ২০২৪

সরকার পতন!

দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার পতনের চেষ্টা

দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার পতনের চেষ্টা বরাবরই চলে আসছে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সেই চেষ্টা বারবার ভেস্তে যায়। তবে দমে যায়নি সেই অপশক্তি। ঘাপটি মেরে উদ্দেশ্য হাসিলের পাঁয়তারা করেছিল। এবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে পুঁজি করে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে লিপ্ত হয়। তাদের টার্গেট কী ছিল? বিটিভির মতো স্পর্শকাতর স্থাপনা দখল করে কি করতে চেয়েছিল রাজনৈতিক চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা? গত কয়েকদিনে গ্রেপ্তার হওয়া সন্ত্রাসীদের মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে কোটার আড়ালে সুপরিকল্পিতভাবে সরকার পতনের সেই পরিকল্পনার কথা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, শিক্ষার্থীদের ব্যানারে পাকিস্তানি কায়দায় জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর করে দেশকে অকার্যকর করতে চেয়েছিল একটি গোষ্ঠী। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় এবারও ভেস্তে যায় সেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পরিকল্পনা। এসব ঘটনায় ইতোমধ্যে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের অনেককে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, কোটা নয়; সরকার পতনই ছিল মূল লক্ষ্য। 
কোটা সংস্কার নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালায়। বিক্ষোভ মিছিল, স্মারকলিপি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের দাবি আদায়ের আন্দোলন। সড়ক অবরোধ করলেও কোনো ধরনের ভাঙচুর, ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হয়নি। ঠিক তখনই বিএনপির নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এতেও কাজ না হওয়ায় রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়ে রাজপথে নামে বিএনপির নেতাকর্মীরা। বিদেশে পলাতক দলটির শীর্ষ নেতার নির্দেশে সারাদেশ থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে ঢাকার উপকণ্ঠে এনে জড়ো করে।

এরপর পরিকল্পনা মাফিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যায়, ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার অলিগলিতে। ‘কোটা সংস্কার ব্যানারের’ আড়ালে হামলা চালায় বিটিভিসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে হত্যা করে বাহিনীর সদস্যদের। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রাণহানি ঘটে বিভিন্ন পেশার মানুষের। সরকারের আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন গুটিয়ে নেয়। কিন্তু তখনো সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে রাজধানীজুড়ে আন্দোলন চালিয়ে যায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর চালাতে থাকে তারা। এসব ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেউ জড়িত নয় বলেও নিশ্চিত করে কোটা আন্দোলনের নেতারা।

এরপরও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে একটি গোষ্ঠী। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভবন, মেট্রোরেল, টোলপ্লাজাসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এসব স্থাপনার পর সচিবালয়, জাতীয় সংসদ ভবনসহ রাষ্ট্রীয় আরও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা-অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা ছিল তাদের। তবে স্বাধীনতাবিরোধী এই গোষ্ঠীকে ঠেকাতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শক্ত হাতে দমন করে অগ্নিসন্ত্রাসীদের। দেশব্যাপী চলে চিরুনি অভিযান। অভিযানে এবং সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্যমতে এসব ঘটনায় জড়িত রাজনৈতিক চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এমন হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে। এতে হামলাকারীদের মুখেই বেরিয়ে আসে মূল উদ্দেশ্য। 
বিটিভি, সেতু ভবনে হামলা-অগ্নিসংযোগে জড়িত বিএনপি ও জামায়াতের সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা হলো ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা-১৮ আসনের বিএনপি প্রার্থী এসএম জাহাঙ্গীর, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতুল্লাহ বুলুর ছেলে সানিয়াত বুলু, মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন খোকন ওরফে কাইল্লা খোকন, কৃষক দলের সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন, ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক মো. মিজানুর রহমান দয়াল, জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য ও বর্তমান সহকারী সেক্রেটারি প্রার্থী অ্যাডভোকেট এস এম কামাল উদ্দীন ও জামায়াতের ভাটারা থানার আমির রেজাউল করিম।

এদের জিজ্ঞাসাবাদে অগ্নিসংযোগ ও হামলাকারী দুই যুবককে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তারা হলোÑ মো. রাকিব (২২) ও মো. জজ মিয়া (২৩)। গ্রেপ্তার বিএনপি-জামায়াতের সাত নেতার নির্দেশে রাকিব ও জজ মিয়া স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে বলে স্বীকার করেছে তারা। গ্রেপ্তার মোট ৯ জন দেশবিরোধী ও নাশকতামূলক কর্মকা-ে জড়িত ছিল বলে জানিয়েছে ডিবি। 
বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা প্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেপ্তার বিএনপি-জামায়াতের সাত নেতা কোটা আন্দোলনের আড়ালে সরকার পতনের টার্গেট নিয়ে মাঠে নামে। বিদেশে পলাতক বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের নির্দেশে তারা সারাদেশ থেকে বিএনপি-জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে ঢাকার উপকণ্ঠে এনে জড়ো করে। পরবর্তীতে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার নির্দেশ দেয়। হামলাকারীদের অর্থের জোগান দেয়।

যে যত বেশি স্থাপনায় হামলা, অগ্নিসংযোগ করতে পারবে, তাকে ততবেশি অর্থ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। এমন উসকানিতে ভাড়াটে খাটা নেতাকর্মীসহ সন্ত্রাসীরা অগ্নিসংযোগ-হামলা চালায়। এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, এদের মূল টার্গেট ছিল কোটা আন্দোলনের আড়ালে সরকারের পতন ঘটানো। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ঘটনাগুলো ঘটায়। পাকিস্তানি কায়দায় হামলা চালিয়ে দেশকে অকার্যকর করার চেষ্টা করে। তারেক রহমান বিদেশ থেকে গ্রেপ্তারকৃতসহ বিএনপির নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে বলেছে, এবার জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, আন্দোলন করে কিছু করতে না পারলে হাতে চুড়ি পরে দল থেকে বের হয়ে যেতে হবে।

এতে নেতাকর্মীরা নিজ অবস্থান জানান দিতে আরও বেশি উগ্র হয়ে হামলা-ভাঙচুর করে, লুটপাট করে। গ্রেপ্তার অনেকেই বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নাম বলেছে, ইন্ধনদাতাদের নাম বলেছি। আমরা তাদের নাম-পরিচয় পেয়েছি। সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। 
রাজনৈতিক চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিটিভি ভবনও। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও পাকিস্তান বাহিনী রাষ্ট্রীয় এই সম্পদে হাত দেওয়ার সাহস পায়নি। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসে রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা এতে হামলা, অগ্নিসংযোগ করে। তারা বিটিভির বার্তা বিভাগে ঢুকে দেশ ও জাতির উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের ঘোষণা দিতে চেয়েছিল বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। 
১৮ তারিখে রামপুরা ও এর আশপাশের এলাকার এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভাড়ায় আনা জঙ্গি, দাগি আসামি, বিএনপির জেলখাটা নেতাকর্মীরা বিটিভি ভবনে ঢুকে যায়। তারা বিভিন্ন কক্ষ, যানবাহন, গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামাদি ভাঙচুর করে, আগুন ধরিয়ে দেয়। বিটিভির মূল কক্ষে অর্থাৎ বার্তা বিভাগে ঢোকার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা রাষ্ট্রীয় এই টেলিভিশন সম্প্রচারের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশে কোনো ধরনের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা চালায়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলে সেটি সম্ভব হয়নি। 
বিটিভিতে হামলা-অগ্নিসংযোগে জড়িত একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। র‌্যাব চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলো গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সদস্য সচিব তারেক রহমান, সহযোগী সজল মিয়া, আল ফয়সাল রফিক ও আরিফুর রহমান। তারা বিটিভিতে হামলার পাশাপাশি মেট্রোরেলে হামলার কথাও স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। 
র‌্যাবের মহাপরিচালক ড. হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার চারজন বিটিভি ভবন ও মিরপুরে মেট্রোরেলে হামলার কথা স্বীকার করেছে। তারা বিটিভির বিভিন্ন কক্ষে ভাঙচুর চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগ করেছে। তাদের সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত ছিল, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজ দেখে বিটিভিতে হামলায় আরও যারা জড়িত, তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারে মাঠে রয়েছে র‌্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন। 
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিট বলছে, প্রথম দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলেও পরবর্তীতে সেই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যায় বিএনপি-জামায়াত। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন বন্ধ করে দিলেও সংঘর্ষ, হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আর এগুলো করেছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজ দেখে এদের বেশির ভাগই শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেই লক্ষ্যে দেশের সীমান্ত এলাকায়ও নজরদারি করা হচ্ছে। 
দুষ্কৃতকারীরা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। আইজিপি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে সবাই গর্বের সঙ্গে বসবাস করবেন। দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটি গোষ্ঠী এমন জ্বলাও-পোড়াও, ভাঙচুর, ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়েছে। এদের ধরতে দেশব্যাপী চিরুনি অভিযান চলমান রয়েছে।

×