ফাইল ছবি।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারছেন না। বিদেশে যেতে হলে তাকে জেলে গিয়ে পুনরায় আবেদন করতে হবে। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদনটি যাচাই বাছাই করে রবিবার আইন মন্ত্রণালয় নাকচ করে দিয়েছে। স্থায়ী মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে গিয়ে পুনরায় আদালতে আবেদন করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী কোনো দরখাস্ত যদি একবার নিষ্পত্তি করা হয়, তবে সেই নিষ্পত্তিকৃত দরখাস্ত পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ এই আইনে থাকে না।
ঠিক সেই কারণে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার উপধারা ১,২,৩,৪,৫ ও ৬ ব্যাখ্যা করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মতামতটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আইন মন্ত্রণালয়ের এ মতামতের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃবৃন্দ পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, আদালতের অনুমতি ছাড়া খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই। খালেদা জিয়ার বিষয়ে সর্বোচ্চ উদারতা দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন খালেদাকে বিদেশ যেতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত মানবতাবিরোধী। বিএনপির আইনজীবীরা বলেছেন, বিষয়টি দলীয় ফোরামে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করতে হবে। ‘তাদের যদি (বিদেশে যাওয়া অনুমতি) চাইতে হয়, তাহলে আবার আদালতে যেতে হবে। আদালতের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। আদালতের কাজের ওপর আমাদের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই।’
দরখাস্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই ॥ স্থায়ী মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে গিয়ে আদালতে আবেদন করতে হবে বলে মত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে রবিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এমপি।
তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসা বিষয়ে তার ভাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর দরখাস্ত দেন। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চায়। আমরা রবিবার মতামত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। আইনমন্ত্রী বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে খালেদা জিয়ার বিষয়ে যে আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে সেটি খোলার আর কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, আমাদের মতামত হলো, প্রথম যে দরখাস্ত ছিল, যেটা ২০২০ সালের মার্চ মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে সেখানে ছিল বেগম খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে তার সুচিকিৎসা যেন হয় সেটার ব্যবস্থা করা। তখন সেই দরখাস্তের ওপর আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, দুটি শর্তসাপেক্ষে তার দন্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এটা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ উপধারা ১ এর ক্ষমতাবলে। সেখানে দুটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো হচ্ছে- প্রথমত তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন। দ্বিতীয়ত তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, শর্তগুলো মেনে তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হন এবং বাসায় ফিরে যান। সেভাবে সে দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়। পরে প্রত্যেক ছয় মাস অন্তর তার মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এভাবে ৮ বার বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা কোনো দরখাস্ত যদি একবার নিষ্পত্তি হয় এই নিষ্পত্তিকৃত দরখাস্ত পুনর্বিবেচনা করার কোনো অবকাশ আইনে থাকে না।
ঠিক সেই ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১ ধারার উপধারা ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬ ব্যাখ্যা করে আমরা আমাদের মতামত পাঠিয়ে দিয়েছি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখানে আমরা মতামত দিয়েছি, ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে যে দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে সেটা পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজ ট্রানজেকশন, এটা খোলার আর কোনো উপায় নেই।
আনিসুল হক বলেন, ২০২০ সালের মার্চে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নির্বাহী আদেশে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার দন্ড স্থগিত করে তাকে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়। শর্তগুলো হলো- তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন ও বিদেশে যেতে পারবেন না। এরপর আট দফা তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। গত ২৫ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার ছোটভাই শামীম ইস্কান্দার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার আবেদন করেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ আবেদন মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেন ঢাকার একটি আদালত। রায়ের পর তাকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এরপর ৩০ অক্টোবর এই মামলায় আপিলে তার সাজা আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে ১০ বছর করেন হাইকোর্ট। একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দেন একই আদালত। এছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সর্বোচ্চ উদারতা দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ॥ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ উদারতা দেখিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সভাপতিমন্ডলীর সদস্যদের যৌথসভা শেষে তিনি এমন মন্তব্য করেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা খালেদা জিয়ার বিষয়ে সংবেদনশীল। তিনি (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বিষয়ে সর্বোচ্চ উদারতা দেখিয়েছেন। তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।’ ভয়েস অব আমেরিকায় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সাক্ষাৎকারে খালেদার চিকিৎসার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন তাতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে।’ বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসার বিষয়ে প্রচলিত আইনে সরকারের কিছু করার নেই জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আইন অনুযায়ী আদালতের দ্বারস্থ হয়ে নির্দেশে মেনে তাকে চিকিৎসা করাতে হবে।’
ভয়ংকর তামাশা ॥ খালেদা জিয়াকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হলে আগে কারাগারে যেতে হবে, তারপর আদালতে আবেদন করতে হবে- আইন মন্ত্রণালয়ের এ মতামত খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। রবিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত জানানোর পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
ব্যারিস্টার কায়সার বলেন, এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে দেশে আইনের শাসন নেই। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, সরকার চাইলেই নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিতে পারে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, নির্বাহী কর্তৃপক্ষ চাইলেই খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া যাবে। তাকে বিদেশে নেওয়া যাবে এবং সেখানে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে। সরকার রাজনৈতিকভাবে প্রতি-হিংসাপরায়ণ হয়েই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে আছে রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়া যেতে পারে।
মানবতাবিরোধী ॥ সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, খালেদাকে বিদেশ যেতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত মানবতাবিরোধী। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেরই বাস্তবায়ন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার জীবন, বেঁচে থাকা এবং উন্নত চিকিৎসায় সুস্থ হওয়া- সব কিছু প্রধানমন্ত্রী আর আইনমন্ত্রীর তামাশার হিংস্রবৃত্তে আটকে গেছে। দেশে এখন চলছে জয়বাংলার আইন। এই আইনে সুশাসন ও ন্যায়বিচার কঙ্কালে পরিণত হয়েছে।
দলীয় ফোরামে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত ॥ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল জনকণ্ঠকে বলেছেন, আইনমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তে আমি হতবাক। আইনমন্ত্রী যে কথা বলেছেন এটা রাজনৈতিক নাটক । এখন আপনারা এ সিদ্ধান্তের পর কি করবেন এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ ফোরামে বসে সিদ্ধান্ত নেব। বিদেশে না পাঠানোর জন্যই তারা ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
এমএম