
প্রযুক্তি সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও, আজ তা মানবতার জন্য এক ভয়ংকর অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সহায়তায় তৈরি ডিপফেক (Deepfake) প্রযুক্তি এখন কেবল বিনোদনের উপকরণ নয়; এটি হয়ে উঠেছে বিভ্রান্তি, অপপ্রচার ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য মরণাত্মক হুমকি।
ডিপফেক মূলত এমন এক প্রযুক্তি, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কারও মুখভঙ্গি, কণ্ঠস্বর ও আচরণ অবিকল নকল করা হয়, যা সত্য-মিথ্যার সীমানা ধ্বংস করে দেয়। ২০১৭ সালে ‘ডিপফেক’ শব্দটি প্রথম আলোচনায় আসে, যখন এক অনলাইন ব্যবহারকারী বিভিন্ন সেলিব্রিটির মুখ ব্যবহার করে ভুয়া ভিডিও তৈরি করেন। এরপর থেকে এই প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, আর তার সঙ্গে বেড়েছে এর ভয়াবহতা।
বিশ্ব রাজনীতিতে ডিপফেকের প্রভাব ইতোমধ্যেই স্পষ্ট। ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডিপফেক ভিডিওর মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির আত্মসমর্পণের ভুয়া ভিডিও বিশ্বমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
যদিও প্রকৃত ভিডিও ও সত্যতা দ্রুত প্রকাশিত হয়, তবুও প্রমাণিত হয় ডিপফেক তথ্য যুদ্ধের সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র হয়ে উঠছে। একই সময়ে চীনে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কনটেন্ট মডারেশন নীতিমালায় ডিপফেক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়; যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও ডিপফেক সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের দাবি জোরালো হয়।
ডিপফেক প্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে রাজনৈতিক প্রচারণা, ব্যক্তিগত চরিত্র হনন, সাইবার প্রতারণা এবং পর্নোগ্রাফিতে। মাত্র কয়েক মিনিটের কাজেই তৈরি করা সম্ভব হয় এমন ভিডিও, যা একজন সাধারণ দর্শকের পক্ষে আসল-নকল পার্থক্য করা প্রায় অসম্ভব।
বাংলাদেশও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে হাঁটতে হাঁটতেই আমরা দেখেছি, কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা যায়। সামনের জাতীয় নির্বাচন, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সামাজিক অশান্তি তৈরির জন্য ডিপফেক ব্যবহার ভয়াবহ আকার নিতে পারে।
বর্তমানে বিদ্যমান ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ বা ‘সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল’ ডিপফেক সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধে সম্পূর্ণ প্রস্তুত কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ডিপফেক প্রযুক্তি মূলত সত্য ও মিথ্যার মধ্যে বিভ্রান্তির দেয়াল তোলে।
যখন একজন নাগরিক আর কোনো ছবি, ভিডিও বা অডিওর সত্যতা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারে না, তখন গণতন্ত্র দুর্বল হয়, ন্যায়বিচার বিপন্ন হয় এবং সমাজে চরম অনাস্থা ছড়িয়ে পড়ে। এটি কেবল প্রযুক্তির অপব্যবহার নয়, এটি সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র।
এই সংকট মোকাবিলায় কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যেমন-
প্রথমত, উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিপফেক শনাক্তের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ডিপফেক প্রস্তুত ও ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে ডিজিটাল সাক্ষরতা (Digital Literacy) বিষয়ক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে জনগণ সহজেই ভুয়া কনটেন্ট শনাক্ত করতে শেখে।
বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের জন্য যুদ্ধ এখন আর কেবল সাংবাদিকদের দায় নয়; এটি আজ সামাজিক অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। তথ্যের মিথ্যা বন্যার বিরুদ্ধে সত্যের দুর্গ নির্মাণ ছাড়া সামনে কোনো পথ নেই। ডিপফেকের ভয়াল মরণফাঁদে আটকে যাওয়ার আগেই আমাদের প্রযুক্তি, আইন এবং সচেতনতাকে সমন্বিত করে অগ্রসর হতে হবে।
অন্যথায়, মানব সভ্যতা এক ভয়ংকর মিথ্যার সমুদ্রে ডুবে যাবে, যেখানে সত্য খুঁজে পাওয়াই হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ
কুতুবে রব্বানী