ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

টরেন্টোর চিঠি

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণ কী

ড. শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:১১, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণ কী

টরেন্টোর চিঠি

২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল, এই ১৫ বছরে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ বছরের মতো। এটা একটা উল্লেখযোগ্য এমনকি প্রায় অবিশ্বাস্য বিষয়। সাধারণত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দুই যুগের মধ্যে মানুষের গড় আয়ু এই পরিমাণ বাড়তে পারে। কেননা, যুদ্ধাবস্থায় প্রচুর মানুষ মারা যাওয়ায় তাদের গড় আয়ু প্রথমে কমতে থাকে, তারপর আবার বাড়ে।

যেমনÑ ১৯৩৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মানদের গড় আয়ু ছিল ৬১.৫৮ বছরের মতো, যেটি ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এসে নেমে যায় মাত্র ৪৫.৯৪ এ। এই সময়ে যুদ্ধে মারা যায় প্রায় ৮০ লাখ জার্মান। স্বাভাবিকভাবেই তাই তাদের গড় আয়ুও কমে আসে। একইভাবে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৮.৬৩ বছর, যেখানে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধের পর সেটি কমে ৪৫ বছরে নেমে আসে। এর একটি বড় কারণ ছিল মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ মানুষের ভয়াল সংখ্যা।

কিন্তু ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটেনি যে, গড় আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে প্রথমে কমে, পরে আবার বাড়তে পারে। এই সময় বাংলাদেশের অবস্থা স্থিতিশীল ছিল। স্থিতিশীল অবস্থায় দেশে ধারাবাহিক উন্নতি হলে গড় আয়ু বাড়তে থাকে। কিন্তু সেটিও খুব দ্রুত হয় না। যেমনÑ ২০০৮ সালে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের গড় আয়ু ছিল ৬৬.১৫ বছর। যেটি ২০২৩ সালে এসে হয় ৬৭.৭৪ বছর।

অর্থাৎ ১৫ বছরে ভারতের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে গড় আয়ু বেড়েছে মাত্র দেড় বছরের মতো। পাকিস্তানে ২০০৮ সালে গড় আয়ু ছিল ৬৪.০৪ বছর, যেটি ২০২৩ সালে এসে হয় ৬৬.৪৩ বছর। কিন্তু এই ১৫ বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির পরিসংখ্যান চমকে ওঠার মতো। ২০০৮ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৭.০৫ বছর।

কিন্তু মাত্র ১৫ বছরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালে এটি এসে দাঁড়ায় ৭৩.৭০ বছরে। এই অগ্রগতি সারা বিশ্বেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আলোচিত হয়েছে। বিবেচিত হয়েছে প্রণিধানযোগ্য হিসেবে।
কোন্্ বিষয়গুলো বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এত দ্রুত সময়ে বাড়াতে সহায়তা করেছে? এর পেছনে শত শত কারণ আছে। কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরব। এই লেখায় যেসব তথ্য ব্যবহার করেছি সেগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস, গ্লোবাল ইকোনমিক ড্যাটা, ম্যাকরোট্রেন্ডস, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ৬, জাতিসংঘ, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন, ফোর্বস, গার্ডিয়ান, রয়টার্স, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, স্ট্যাটিসটিকা থেকে নিয়েছি।

২০০৮-এর সঙ্গে ২০২৩ এর পরিসংখ্যানের তুলনা করেছি। কারণ, ২০২৩-এর পরিসংখ্যানগুলো ২০২৪-এ প্রকাশিত হয়েছে এবং সব সূচক বিবেচনা করতে গেলে এটিই সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান। কিছু ক্ষেত্রে ২০২৩-এর জায়গায় ২০২২ বা ২০২৪-এর পরিসংখ্যানও ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, সেগুলোই সবশেষ প্রাপ্ত তথ্য। বিভিন্ন সূচকের সংখ্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সোর্সে কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে। যেমনÑ কেউ ২০০৮-এর জিডিপি ৬৩০ ডলার বলতে পারে, কেউ কেউ বলতে পারে ৬৮০ ডলার।

এছাড়াও পুরো লেখায় ডলার বলতে আমি মার্কিন ডলার বুঝিয়েছি, কানাডিয়ান ডলার নয়। আমি যদি তুলনার ক্ষেত্রে কোথাও ‘এখন’ শব্দটি ব্যবহার করি, তাহলে ধরে নেবেন পরিসংখ্যানটি ২০২৩ সালের। কিন্তু যেটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সেটিই ব্যবহার করেছি। এছাড়াও কিছু গবেষণাপত্র ও গবেষণা পদ্ধতিকে ভিত্তি হিসেবে ধরেছি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, Spearman's rank correlation coefficient। স্পিয়ারম্যানের এই পদ্ধতি নানা সূচককে তুলনার মাধ্যমে একটি র‌্যাংক লক করে।

এটি মোটামুটি জটিল একটি প্রক্রিয়া, কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়নে যেসব গবেষণাপত্রে এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোকে বিবেচনায় এনেছি। এছাড়াও যেহেতু অসংখ্য সূচক নিয়ে কাজ করা হয়েছে, তাই Multiple Linear Regression model ব্যবহার করা হয়েছে এই সূচকগুলোর প্রকৃত প্রভাব যাচাই করতে।
আসুন, কয়েকটা সূচক নিয়ে কথা বলি। ২০০৮ সালে যেখানে বাংলাদেশের এউচ ছিল ৬৩০ ডলারের মতো, সেখানে ২০২৩ এ এসে সেটি হয়েছে ২৬০০ ডলারের কাছাকাছি। মানে ১৫ বছরে দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় পণ্যের মাথাপিছু উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ গুণ। যদি বাংলাদেশের মানুষের গড় বার্ষিক আয় বিবেচনা করেন, তাহলে সেটি ২০০৮ সালে ছিল ৬৬০ ডলার, যেটি ১৫ বছরে বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৯০০ ডলার!

আমরা যদি এঘচ বা বাংলাদেশের বৈশ্বিক বার্ষিক উৎপাদন বিবেচনা করি, তাহলে সেটি ২০০৮ সালে ছিল ৯৬ বিলিয়ন ডলার আর ২০২৩ এ এসে দাঁড়িয়েছে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।২০০৮ সালে যেখানে Skilled Birth Attendance বা সন্তান প্রসবের সময় দক্ষ জনশক্তির উপস্থিতি ছিল ২১ শতাংশের মতো, সেটি এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশের ওপরে।

২০০৮ সালে বাংলাদেশে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ছিল ৫০-এর মতো, যেটি এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৫টির কাছাকাছি। সরকার এই সময়ে বাংলাদেশে হিব টিকা (২০০৯), রুবেলা টিকা (২০১২), পিসিভি এবং আইপিভি টিকা (২০১৫), এমআর দ্বিতীয় ডোজ (২০১৫) এবং এফআইপিভি টিকা (২০১৭) ইত্যাদি প্রচলন করেছে, কিংবা এর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করেছে।

করোনার সময়ে বিশ্বের অনেক দেশকে ডিঙিয়ে কীভাবে করোনা ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আনা হয়েছে, সেটি আমরা সবাই দেখেছি। এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে কালা-জ্বর এবং lymphatic filariasis- এই দুটি রোগ নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে। এই সময়ে শিশু মৃত্যুর হার ১০০০ জন শিশুতে ৪৪ এর জায়গায় কমে ২৫-এ নেমেছে।

মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১ লাখে ১৯৬ থেকে কমে ১২৩-এ নেমেছে। Adult Literacy Rate বা প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার ৫৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৭ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির হার ৭ থেকে বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির হার ২০০৮ সালে ছিল ৯৭ শতাংশ, যেটি এখন ৯৯ শতাংশের ওপরে।
বাংলাদেশের মানুষের পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে রাজনৈতিক কিছু বিষয় আছে। এই তথ্যগুলো নানা সময়ে নানা প্রতিষ্ঠান সধহরঢ়ঁষধঃব করেছে নিজেদের সক্ষমতা দেখানোর জন্য। যে কারণে বেশির ভাগ তথ্যই বাস্তবতা নির্দেশ করে না। যেটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান আমার মতে, সেটি হচ্ছে ২০০৮ সালে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের পানির উৎসে অভিগম্যতা ছিল। যেটি এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ শতাংশে।

কিন্তু আমরা যদি মানুষের নিরাপদ পানি পান করার কথা বলি, তাহলে সেই হার আগের থেকে বেড়ে এখন ৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একটা দীর্ঘ সময়ে আর্সেনিক আমাদের পানিতে বড় সমস্যা ছিল। এখন এটা আগের চাইতে কম শোনা গেলেও সুপেয় পানির তথ্য নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব আছে। জাতিসংঘের তথ্য মতে, বাংলাদেশের ৩১ শতাংশ মানুষ গ্রহণযোগ্য ও নিরাপদ ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। আমার হিসেবে তা স্বাভাবিকভাবে ৭০-৮০ শতাংশের কাছাকাছি হবে।

হাইজিনের ক্ষেত্রে মানুষ হাত ধোয় ৬২ শতাংশ ক্ষেত্রে। যেটি গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সংক্ষেপে গত ১৫ বছরে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন নিয়ে পরিসংখ্যানের ছলচাতুরী বাদ দিলেও অগ্রগতি ছিল স্থিতিশীল। তবে এসব যে কখনই ৮০-৯০ শতাংশ ছিল না, এটি এখন পরিষ্কার। তবে হাইজিন, হাত ধোয়া, মেয়েদের মাসিক সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি, পাবলিক টয়লেট, পানির প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে সংখ্যাগত উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হলেও, মানগত ও প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছে। যেহেতু এই সেক্টরে দীর্ঘদিন কাজ করেছি, এই অংশটি একটু বড় হয়ে গেল।
উন্নয়নের একটি প্রধান সূচক GDP growth rate ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ২ শতাংশ, যেটি ২০২৩ সালে এসে হয় ৬ শতাংশ। উল্লেখ্য, আইএমএফ ধারণা করছে, এটি এই বছর কমে ৩.৫ এ নেমে যাবে, যেটি বাংলাদেশের করোনার পর সবচেয়ে দ্রুত ও আকস্মিক অধঃপতন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। ২০২৩ সালে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছিল।

সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের পর বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের ৩০ শতাংশ মানুষ মাত্র এই এক বছরেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। বিশ্বমন্দার মধ্যে বাংলাদেশ কীভাবে আগামী দিনগুলোতে নিজেকে প্রস্তুত করে, এখন সেটিই দেখার বিষয়। 
২৯ এপ্রিল ২০২৫

[email protected]

×

শীর্ষ সংবাদ:

যেই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে: আমীর খসরু
জামায়াত নেতারা রাজাকার হলে পাকিস্তানে গাড়ি বাড়ি থাকতো : শামীম সাঈদী
এনসিপির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা নেই- উমামা ফাতেমা
‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটকদের অধিকাংশই ভারতীয় মুসলমান
ইয়েমেনে হামলা চালিয়েই সাগরে ডুবে গেল মার্কিন সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান
জামিন পেলেননা তারেক রহমানের খালাতো ভাই তুহিন
লন্ডনে আজ আর্সেনাল পিএসজি মহারণ
১৭ অভিনয়শিল্পীর নামে মামলা, তালিকায় আছেন নুসরাত ফারিয়া-অপু বিশ্বাস-ভাবনাসহ অনেকেই
১০০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ডের ১১৯তম ড্র অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল
স্বর্ণের দাম, রেকর্ড উচ্চতা থেকে পতনের পথে
কুমিল্লায় পুলিশ-সেনাবাহিনীর চাকরির নামে প্রতারণা: দালালসহ ১৩ জন গ্রেফতার
১২ বছর বয়সী ছেলে শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের অভিযোগে ৩ মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেফতার