
উপমহাদেশের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত-পাকিস্তান বর্তমানে মুখোমুখি অবস্থানে। সম্প্রতি কাশ্মীরের পেহেলগাঁর জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র বৈসারণ উপত্যকায় বন্দুকধারীদের হামলায় প্রায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হন। সবাই ভারতীয়। একজন নেপালি পর্যটক। সর্বশেষ, ২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ভারতের ৪১ জন সেনা নিহত হন। ওই হামলার পর পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত। কাশ্মীরে হামলার ঘটনায় দুই দেশই পরস্পরের প্রতি অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করেছে। কাশ্মীরে যখনই কিছু হয় ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। আবার বেলুচিস্তানে কিছু হলে পাকিস্তান ভারতকে দায়ী করে। উভয় ক্ষেত্রেই তারা পাল্টাপাল্টি কিছু ব্যবস্থা নেয়। এখন কথা হচ্ছে, এই পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা কোথায় গড়াতে পারে? ভারতীয় জনগণের মধ্যে হাইপ সৃষ্টি হয়েছে, মিডিয়াও বড় আকারে হাইপ তুলেছে বলে ভারত সরকারকে কিছু একটা করতে হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘হামলাকারী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে। যারা এই নীলনক্সা সাজিয়েছিল, তাদের কল্পনাতীত পরিণতি ভোগ করতে হবে। সন্ত্রাসীদের যত সামান্য ভূমিকাই থাকুক না কেন, এখনই সময় এসেছে তা ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার। ১৪০ কোটি ভারতীয়র ইচ্ছাশক্তি এই সন্ত্রাসীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে।’ ভারত প্রতিবেশী দেশটির নাগরিকদের ভিসা বাতিলসহ পাঁচটি পদক্ষেপ নিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও রয়েছে আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ, দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনে নিযুক্ত সব সামরিক উপদেষ্টাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, হাইকমিশনে কর্মকর্তার সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ জনে আনা এবং সব পাকিস্তানির ভিসা বাতিল করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশত্যাগ করতে বলা হয়েছে।
ভারতীয় নাগরিকের দেওয়া সব সার্ক ভিসা বাতিল করেছে পাকিস্তান। এই ভিসার আওতায় পাকিস্তানে অবস্থানরত সব ভারতীয় নাগরিককে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে নির্দেশ দিয়েছে দেশটি। অবশ্য শিখ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির। এ ছাড়া ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে নিযুক্ত দেশটির প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। অবিলম্বে তাঁদের দেশটি ছাড়তে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মকর্তা ৩০ জনে নামিয়ে আনতে ভারতের অনুরূপ সিদ্ধান্ত দিয়েছে পাকিস্তান। সিন্ধু পানি চুক্তি প্রসঙ্গে পাকিস্তান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান যে পরিমাণ পানি পাবে তার প্রবাহ থামানো কিংবা অন্যদিকে নেওয়ার যেকোনো চেষ্টা হবে যুদ্ধের শামিল। পাকিস্তান বলেছে, ‘সিন্ধু পানি চুক্তি, বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় হওয়া একটি বাধ্যবাধকতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি, এককভাবে এই চুক্তি স্থগিতের কোনো বিধান নেই। পানি পাকিস্তানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়, যা দেশের ২৪ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে। যেকোনো মূল্যে এই পানি পাওয়ার বিষয়টি রক্ষা করা হবে।’
সিন্ধু নদীর পানির প্রবাহ রক্ষায় পূর্ণ শক্তি প্রয়োগেরও ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান। উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারতের পক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের পক্ষে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সিন্ধু পানি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এ চুক্তির আওতায় সিন্ধু, চন্দ্রভাগা, শতদ্রু, ঝিলাম, ইরাবতী ও বিপাশা নদীর পানি পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়।
পাকিস্তান ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা বাতিল, দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিত, ভারতীয় উড়োজাহাজের জন্য আকাশসীমা বন্ধসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতীয় বিমানের জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা নিষিদ্ধ করায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে ভারত। পাকিস্তান সিভিল এভিয়েশন অথরিটি এক নোটিসে জানিয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দেশটির আকাশসীমা ভারতীয়-নিবন্ধিত বেসামরিক এবং সামরিক বিমানের জন্য বন্ধ থাকবে। এমনকি ভারতীয় সংস্থাগুলোর ভাড়া নেওয়া বিমানগুলোও পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে না। প্রতিদিন ১০০টির বেশি ভারতীয় বিমান পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করে। পাকিস্তানি আকাশসীমা বন্ধের ফলে ভারতীয় বিমানগুলোকে অতিরিক্ত দুই ঘণ্টা পথ ঘুরে গন্তব্যে যেতে হবে।
ফলে, প্রতিদিন ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। পাকিস্তান ভারতের পদক্ষেপকে বেপরোয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীন আখ্যায়িত করেছে এবং বলেছে, এর মাধ্যমে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তসমূহ আন্তর্জাতিক আইন ও বাধ্যবাধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে।
পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিতের অধিকার প্রয়োগ করবে এবং তা শুধু সিমলা চুক্তি স্থগিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ইসলামাবাদ বলেছে, ভারত পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসবাদ উসকে দেওয়া ও আন্তঃসীমান্ত হত্যা বন্ধ না করা পর্যন্ত এবং আন্তর্জাতিক আইন ও কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবসমূহ মেনে না চলা পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় সব চুক্তি স্থগিত থাকবে।
কাশ্মীরে হামলা ও পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে নয়াদিল্লিতে সর্বদলীয় বৈঠক করেছে মোদি সরকার। সন্ত্রাসীদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সব দল। সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে ভারত সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছেন দলগুলোর নেতারা। কাশ্মীরে হামলার পর ভারত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সে বিষয়ে দেশটিতে নিযুক্ত ২০টি দেশের কূটনীতিকদের অবহিত করেছে নয়াদিল্লি।
ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিরসনে উভয় পক্ষকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি। ইসলামাবাদের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছে দিল্লি। এ খবর দিয়েছে অনলাইন জিও নিউজ। এতে বলা হয়, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে পর্যটকের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনার পটভূমিতে এই মন্তব্য করেছেন পিপিপি প্রধান। ভারতের অভিযোগ, কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার মদদদাতা পাকিস্তান। যদিও বারবার দিল্লির এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইসলামাবাদ। এই নিকৃষ্ট হামলার নিন্দা জানিয়ে ঘটনার নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের প্রস্তাব দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। এদিকে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশকেই সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস। এর আগে সিন্ধুর পানি চুক্তি নিয়ে ভারতের উদ্দেশে কঠোর বার্তা দেন বিলাওয়াল। সুক্কুরে এক জনসমাবেশে তিনি বলেছেন, সিন্ধু আমাদের এবং আমাদেরই থাকবে। হয় এর ভিতর দিয়ে পানি প্রবাহিত হবে, নয়তো ভারতীয়দের রক্ত। দুই দেশের রাজনীতিবিদরাই উত্তেজনাকর বক্তব্য দিচ্ছেন, যা কোনো দেশের ভবিষ্যতের জন্যই কল্যাণকর নয়।
ভৌগোলিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের তিন দিকে ভারতের বিশাল সীমান্ত রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে তার কী প্রভাব পড়বে? সতর্কতার জন্য বাংলাদেশের করণীয় কী- এমন হাজারো প্রশ্ন দেশের নাগরিকদের মাঝে। বাংলাদেশকে অবশ্যই সর্তক অবস্থানে থাকতে হবে। কেননা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনা পুরো অঞ্চলেই পড়বে। পাক-ভারত উত্তেজনার কারণে উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরেকটু জটিল হলো। দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো ঘটনার প্রভাব প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপর পড়ে এবং নাগরিকদের মধ্যেও এর নানাবিধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
এ কঠিন বাস্তবতায় বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে কবি, দার্শনিক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকার অর্থে দায়িত্বশীল না। এখানে ধর্মীয় জাতিবাদী গোষ্ঠীগুলোরও কোনো ভূরাজনৈতিক কম্প্রিহেনসিভ দৃষ্টিভঙ্গি নেই। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের পক্ষে কাজ করতে কীভাবে কথা বলতে হয়, কোনো ভাষায় বলতে হয় এটা নিয়ে সত্যিকার অর্থে তারা সচেতন নয়। সব মিলিয়ে আমি চিন্তিত যে, কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে। আমাদের আরও অনেক বেশি বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, সহনশীলতা ও সংবেদনশীলতা দরকার।’
‘সঠিক তথ্য যেহেতু এখনো পরিষ্কার নয়, আমরা যেন প্রোপাগান্ডায় বিভক্ত বা বিভ্রান্ত না হই। নিরীহ-নিষ্পাপ মানুষকে হত্যা করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। এটার মধ্যে ইসলামের কোনো গৌরব বা মহিমা নেই। এটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ হয়েছে এবং আমরা এর নিন্দা জানাই। সবমিলিয়ে জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা পড়েছি। আমাদের ঠান্ডা মাথায় সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।’
লেখক : সাংবাদিক
প্যানেল