
সদ্যপ্রয়াত বিশ্বের একশত বিশ কোটি ক্যাথলিক খ্রিস্টানের প্রধান ধর্মগুরু এবং ভাটিকান সিটি রাষ্ট্রের প্রধান পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত এক মহামানব। পোপ হিসেবে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী একজন নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি অতি সাধারণ জীবন যাপন করেছেন, বিলাসিতা থেকে দূরে থেকেছেন এবং অসামান্য বাণী রেখেছেন, কাজ করেছেন এবং অবিস্মরণীয় জীবন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে ক্যাথলিক মণ্ডলী (চার্চ) এবং ক্যাথলিক সম্প্রদায়কে বের করে এনে উদার করে তুলতে নানামুখী সংস্কার চালু করেছেন। ধর্মীয় আইন ও নীতির বড় কোনো পরিবর্তন না করেও দয়া, ক্ষমা ও ভালোবাসার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি চার্চকে বিশ্বের একটি ‘ফিল্ড হাসপাতালে’ পরিণত করার কথা বলেছেন, যেখানে নানা প্রকার সংঘাতে আহত মানুষ সেবা পেতে ও সুস্থতা লাভ করতে পারবে। তিনি বলতেন, ‘ক্যাথলিক চার্চ হলো দরিদ্রদের দ্বারা এবং দরিদ্রদের জন্য।’ তিনি দরিদ্র, অবহেলিত, নির্যাতিত, শরণার্থী, অভিবাসী এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অসহায় মানুষের অধিকার রক্ষার সোচ্চার ছিলেন তিনি। ‘আমার জনগণ দরিদ্র এবং আমি তাদেরই একজন’- একথা তিনি বহুবার বলেছেন।
ক্যাথলিক চার্চকে তিনি ‘ইউরোপকেন্দ্রিক চার্চ’ থেকে সরিয়ে এক ‘সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন’ চার্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে সাক্ষাৎকালে তাদের ‘ঈশ্বরের উপস্থিতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাকে নতুন করে বিশ্ব নজরে নিয়ে আসেন।
খ্রিস্টধর্মের একজন গুরু হয়েও তার বারো বছরের পোপীয় শাসনামলে পোপ ফ্রান্সিস জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে সর্বজনপ্রিয়, মানবতাবাদী, উদার, সম্প্রীতির অগ্রদূত ও শান্তিকামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মান ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। বিগত ২১ এপ্রিল বার্ধক্যজনিত নানাবিধ জটিলতায় ভুগে ৮৮ বছর বয়সে এ মহাপুরুষ পরলোক গমন করেছেন। তাঁর এ মহাপ্রয়াণ গোটা বিশ্বকে শোকসাগরে ভাসিয়েছে। কারণ তিনি তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে বিশ্ব বিবেককে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস তাই কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা শ্রেণির নন, বিশ্বের সকল মানুষের নেতা, আদর্শ এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। বিগত ২৬ এপ্রিল ভাটিকানের বিখ্যাত সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বিশ্বের প্রায় একশত দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাজা ও প্রতিনিধি, বিভিন্ন ধর্ম এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতাসহ আড়াই লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। একবিংশ শতাব্দীতে আর কোনো বিশ্ব নেতা বা ধর্মগুরুর প্রয়াণে মানুষের এত আবেগ ও শ্রদ্ধার বহির্প্রকাশ দেখা যায়নি।
খুব সাধারণ পরিবারে জন্ম হলেও অসাধারণ কর্মগুণে পোপ ফ্রান্সিস বিশ্ব পরিচিতি পেয়েছেন। ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এইরেসে এক ইতালীয় অভিবাসী পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা-মার দেওয়া নাম হোর্হে মারিও বেরগোগলিও। তাঁদের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বেরগোগলিও সবার বড়। নিজ শহরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শেষ করে তিনি রাসায়নিক প্রযুক্তিবিদ (কেমিক্যাল সায়েন্টিস্ট) হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুদিন তিনি হাত খরচের জন্য নাইট ক্লাবের বাউন্সার হিসেবে কাজ করেন। সে সময় আর্জেন্টিনায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুরাবস্থা চলছিল। তিনি প্রায়ই রাস্তাঘাটে এবং বস্তিতে দরিদ্র মানুষের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতেন। সেই থেকে তিনি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার কথা ভাবতে শুরু করেন। মূলত সেই ভাবনা থেকেই তিনি ১৯৫৮ সালে প্রখ্যাত ধর্মসংঘ সোসাইটি অব জিসাস (যীশু সংঘ বা জেজুইট) -এ যোগদান করেন। জেজুইট সম্প্রদায় বিশ্বজুড়ে তাদের শিক্ষাসেবা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং সামাজিক কার্যক্রম তথা দরিদ্র ও নিপীড়িতের জন্য কাছের জন্য সুখ্যাত। প্রায় বারো বছর প্রশিক্ষণ ও পড়াশোনা শেষ করে ১৩ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সালে যাজক পদে অভিষেক লাভ করেন। যাজক ও পালক হিসেবে বিভিন্ন ভূমিকা ছাড়াও তিনি ১৯৭৩-১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনায় যীশু সংঘের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি বুয়েন্স এইরেসের সহকারী বিশপ এবং ১৯৯৮ সালে আর্চবিশপের দায়িত্ব লাভ করেন। ২০০১ সালে প্রয়াত পোপ ২য় জন পল তাঁকে সম্মানসূচক কার্ডিনাল পদে মনোনীত করেন। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ তিনি ২৬৬তম পোপ হিসেবে নির্বাচিত হন। পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের প্রথম পোপ, জেজুইট সম্প্রদায় থেকে প্রথম পোপ এবং ১,৩০০ বছরের মধ্যে ইউরোপ মহাদেশের বাইরে থেকে প্রথম পোপ।
শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার প্রসারে পোপ ফ্রান্সিস বিশেষভাবে কাজ করেছেন। তিনি তাঁর পোপীয় শাসনামলে ৬৮টি দেশ সফর করেছেন এবং এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই হলো অন্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত, এমনকি ইরাক ও বাইরাইনের মতো দেশ যেখানে আগে কোনো পোপ পা রাখেননি। এগুলোর মধ্যে অন্যতম বৌদ্ধ অধ্যুষিত শ্রীলংকা, থাইল্যাণ্ড, জাপান, মঙ্গোলিয়া এবং মুসলিম অধ্যুষিত জর্দান, ফিলিস্তিন আলবেনিয়া, তুরস্ক, বসনিয়া, মিশর, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাইরাইন, আজারবাইজান, মরক্কো, কাজাখস্থান, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া। হিন্দু অধ্যুষিত ভারত সফরের ইচ্ছা ছিল প্রবল। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী গ্রুপগুলোর চাপে সে দেশের সরকার তাঁকে যথাসময়ে আমন্ত্রণ জানাতে পারেনি। ফলে তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। সকল দেশে এবং ভাটিকানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে বিভিন্ন ধর্মের নেতাদের আপনজনের মতো বুকে টেনে নিতে দেখা গেছে। তিনি পাশ্চাত্যে প্রবল ‘ইসলামবিদ্বেষী’ মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং একই সঙ্গে ধর্মের নামে সকল প্রকার বিদ্বেষ ও সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনসহ সকল প্রকার যুদ্ধ, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি ফিলিস্তিনিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন।
পোপ ফ্রান্সিস হলেন সর্বাধিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভ্রমণ করা পোপ। তিনি তাঁর সফরে প্রধান প্রধান ধর্মের নেতা ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ভাইয়ের মতো আলিঙ্গন করেছেন। তিনি যেমন খ্রিস্টানদের চার্চ পরিদর্শন করেছেন, তেমনি বৌদ্ধ মন্দির ও মসজিদও পরিদর্শন করেছেন। তিনি বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মধ্যে সর্বদা সুসম্পর্ক বজায় রাখার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বিশেষভাবে মনে করতেন বিশ্ব শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে ধর্মের জোরালো ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে তিনি আবুধাবি সফরকালে মিশরের বিখ্যাত আল-আজহার মসজিদের গ্র্যান্ড ইমাম শেখ আহমেদ আবু তাইবের সাথে যৌথভাবে ‘ডকুমেন্ট অন হিউম্যান ফ্র্যাটার্নিটি ফর ওর্য়াল্ড পিস এ্যান্ড লিভিং টুগেদার’ স্বাক্ষর করেন।
‘আবুধাবি ঘোষনা’ নামে পরিচিত এ ডকুমেন্টটিকে বিশ্ব শান্তি স্থাপনে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও সম্প্রীতি বজায় রাখার এক মহৎ ও উৎকৃষ্ট ইশতেহার হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০২০ সালে তিনি ‘ফ্রাতেল্নি তুত্তি’ (Fratelli Tutti) বা ‘আমরা সকলে ভাই-বোন’ নামে যে প্রৈরিতিক পত্র লেখেন সেখানে আবুধাবি ঘোষণার অনেক কিছু স্থান পেয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, সেই ডকুমেন্টের ভিত্তি শুধু কূটনীতি নয়, বরং সংলাপ এবং পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি, যা সকলের জন্য ভালো, তা থেকে নির্গত হয়েছে।
পোপ ফ্রান্সিস নিঃসন্দেহে মানব ইতিহাসের একজন চিরস্মরণীয় এবং অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রকৃতির নিয়মে তিনি তাঁর মহৎ জীবনকে সাঙ্গ করে পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন। তাঁর মহান জীবনাদর্শ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য পালনীয়। আর তা হতে পারে আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব আরও বেশি সুন্দর, বাসযোগ্য এবং মানবিক করে তোলার চাবিকাঠি।
লেখক : সাংবাদিক এশিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ইউসিএ নিউজ (UCA News)-এ বার্তা সম্পাদক
হিসেবে কর্মরত
প্যানেল