ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

দৈনন্দিন কাজে ড্রোনের ব্যবহার

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:০৯, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

দৈনন্দিন কাজে ড্রোনের ব্যবহার

যুদ্ধ ও সামরিক কাজের জন্য ড্রোনের প্রচলন শুরু হলেও বর্তমানে দৈনন্দিন অনেক কাজে এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখযোগ্য হলো পণ্য ডেলিভারি, কৃষি কাজ, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি। ফসলের বৃদ্ধির পর্যায়, ফসলের স্বাস্থ্য এবং মাটির বৈচিত্র্য সম্পর্কে চমৎকার তথ্য প্রদান করে এবং ফলন অপ্টিমাইজেশনে, ফসল উৎপাদন, সুনির্দিষ্ট ফসল পর্যবেক্ষণ, ম্যাপিংয়ে, সার ও কীটনাশক প্রয়োগে কৃষি ড্রোনগুলো বেশ সহায়ক। ডেলিভারি ড্রোন ব্যবহার করে দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে প্যাকেজ, খাবার এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সরাসরি বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত ও চালকবিহীন উড়ন্ত যান ড্রোন ভবিষ্যতে আমাদের জীবনযাত্রায় আরও বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে। ঝুঁকিপূর্ণ অনেক কাজকর্মও অনায়াসে করে দিতে পারবে ড্রোন বা রোবটযান। বিভিন্ন শিল্পকারখানার উৎপাদন থেকে শুরু করে সেবামূলক কাজেও ড্রোন মানুষের সঙ্গী এখন। খনি ও রেল খাতের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ড্রোন ব্যবহারের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছে। পরিবেশ রক্ষা এবং অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কাজেও ভবিষ্যতে ড্রোন ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ মানুষের ফরমায়েশ অনুযায়ী বিভিন্ন জিনিসপত্র ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারটি বাস্তবে ঘটার জন্য অপেক্ষার দিন শেষ। সামরিক কর্মকাণ্ডের বাইরে ড্রোন ব্যবহারের বিভিন্ন খবর ২০১৪ সাল থেকে সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। আর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ড্রোনের ব্যবহার নিয়ে নানা সম্ভাবনার কথাও প্রচার করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ড্রোন প্রযুক্তিতে বর্তমানে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র। ড্রোন ব্যবহারের সুযোগ দিতে ফ্রান্সে ২০১২ সালে ইতিবাচক আইন প্রণয়ন করেছে। আর সে কারণেই দেশটিতে ড্রোন প্রযুক্তির বিশেষ সমৃদ্ধি ঘটছে এবং রেডবার্ডের মতো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট অনেক প্রতিষ্ঠানও ড্রোন তৈরির কাজে যুক্ত হচ্ছে। এ খাতে বর্তমানে দেশটিতে প্রায় দশ হাজার লোক কাজ করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে এখনো কিছুটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়ে গেছে। আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রে ড্রোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি কোনো বাধা নয়। তবে আইনি সীমাবদ্ধতা আছে। ড্রোন ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে এখনো দেশটিতে অনেক গবেষণা ও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশেও ড্রোন তৈরির প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। নতুন একটি কোম্পানি ‘স্কাই বিজ’ এই ড্রোন তৈরি করবে। এর জন্য প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে ‘স্কাই বিজ’ এবং বছরে প্রায় ৭ হাজার ৩১৪টি ড্রোন তৈরির পরিকল্পনা আছে। এসব ড্রোন মূলত বিদেশে রপ্তানি করা হবে এবং প্রতি বছর ১৬৯ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ড্রোন রপ্তানির লক্ষ্য রয়েছে তাদের। প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি অগ্নিনির্বাপণের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রোটারি উইং ইউএভি তৈরি করবে। একই সঙ্গে সিনেমাটোগ্রাফি, ম্যাপিং ও সার্ভিলেন্স উপযোগী ভার্টিক্যাল টেক-অফ ও ল্যান্ডিং ড্রোন বানানো হবে। তবে বেসামরিক কাজ যেমন কীটনাশক স্প্রে, অগ্নিনির্বাপণ, ডেলিভারি সার্ভিস এবং ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় ড্রোন ব্যবহার করা হবে। আরও খুশির খবর হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইতোমধ্যেই দেশের একদল তরুণ তৈরি করেছে ড্রোন, যা ৪০ কিলোমিটার দূরত্বে ১০ কেজি খাবার সরবরাহ করতে পারে। এর উড্ডয়নকাল ১ ঘণ্টা এবং ভূমি থেকেই দুই কিলোমিটার ওপর দিয়ে সে যাতায়াত করতে পারে। এর মানে হচ্ছে ঢাকা থেকে পার্শ্ববর্তী শহর যেমন নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদীতে এই ড্রোন দিয়ে ফুড ডেলিভারি করতে পারবে অনায়াসে। সম্প্রতি ঢাকার একটি রেস্টুরেন্ট এই সার্ভিস চালু করেছে।
এর আগে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১৪ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথম ড্রোন তৈরি করে। সম্প্রতি কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (সিইউবি) শিক্ষার্থী তৈরি করেন ‘ওয়াটার ড্রোন’, যা ২ কিলোমিটার পরিসীমা পর্যন্ত ৭ কেজি ভার বহন করতে সক্ষম। কুয়েটের শিক্ষার্থীরা দেশের মধ্যে কোথায় গোলযোগ হচ্ছে কিংবা দুর্যোগকবলিত দুর্গম অঞ্চলের সচিত্র তথ্য দ্রুততম সময়ে পেতে উদ্ভাবন করেছে মনুষ্যবিহীন স্বয়ংক্রিয় উড়ন্ত যান ‘অটোনোমাস ড্রোন’। ফলে এ ড্রোন সীমান্তের চোরাচালান নজরদারিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি দুর্গম অঞ্চলে জরুরি ওষুধ সরবরাহের কাজে সহায়ক হতে পারে। কখন কোথায় যেতে হবে তা গুগল ম্যাপের সহায়তায় নির্দিষ্ট করে দিলেই ড্রোনটি সুনির্দিষ্ট পথ পরিভ্রমণ করে আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরে আসে। এ ড্রোন দিয়ে জরুরি পণ্য পরিবহনও সম্ভব। এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্যও আগাম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারবে। এদিকে চীনা ড্রোন বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় এবারের বাংলা নববর্ষে সংসদ ভবন চত্বরে এক ব্যতিক্রমধর্মী ড্রোন শো’র আয়োজন করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।
ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পণ্য সরবরাহ কার্যক্রম দ্রুত গতিতে রূপান্তর হচ্ছে যা ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী পরিবহন পদ্ধতিতে আধিপত্য বিস্তারের সম্ভাবনা প্রদর্শন করে। উচ্চগতি এবং কম ব্যয়বহুল রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবহার এবং পরিবেশগত সুবিধা তৈরি করে ড্রোনগুলো প্রচলিত সরবরাহ ব্যবস্থার একটি শক্তিশালী প্রতিস্থাপন হিসেবে কাজ করছে। সম্প্রতি ‘টিওয়াইআই ডেলিভারি ড্রোন’ প্যাকেজ পাঠানোর জন্য খুবই দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য করে ডিজাইন করা হয়েছে। দ্রুত গতিতে এবং সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এতে আধুনিক নেভিগেশন ও অটোমেশন পদ্ধতি ব্যবহার  করা হয়েছে। টিওয়াইআই ডেলিভারি ড্রোনটি বড় বহন ক্ষমতা পরিচালনা করতে সক্ষম, যা গ্রামীণ  এবং শহর উভয়ের জন্যই উপযুক্ত। ড্রোন পরিচালনার প্রধান সুবিধা হলো এর গতিভিত্তিক যোগাযোগহীন ডেলিভারি পরিষেবা, যা বিশেষ করে দুর্গম এবং জরুরি অঞ্চলে ভালোভাবে কাজ করে। কোভিড-১৯ মহামারী ড্রোন ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়েছে, যার ফলে বাজারসদাই এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি ওষুধ পাঠানোর জন্য ড্রোনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ড্রোন ডেলিভারি বাজার উচ্চ গতিতে প্রসারিত হবে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
বিশ্ববাসী দেখতে পাচ্ছে  যে ড্রোন এক সময় শুধু যুদ্ধের সরঞ্জাম সরবরাহের কাজে ব্যবহার হতো, তা এখন পদাতিক এবং আর্টিলারির পাশাপাশি দুই পক্ষের (রাশিয়া ও ইউক্রেন) জন্য একটি কেন্দ্রীয় উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) জোটের পূর্ব সীমান্তে ‘ড্রোন ওয়াল’ নামে পরিচিত একটি অত্যাধুনিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে, যার আওতায় নরওয়ে থেকে পোল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে মোতায়েন করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চালিত হাজারো ড্রোন। মূলত রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসন মোকাবিলা এবং জোটভুক্ত দেশগুলোর নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এই প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য। যাহোক, ড্রোনের ব্যবহার বেশ সম্ভাবনাময় হলেও তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও আইনি বিধিনিষেধ রয়েছে। ফ্রান্সের একটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর দিয়ে সম্প্রতি একাধিক ড্রোন উড়ে যায়। আর ড্রোনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যাত্রীবাহী দুটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এতে ড্রোন নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে ব্যাপকহারে ড্রোন ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ। ড্রোনের অবাধ ব্যবহারের কারণে মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকির যে আশঙ্কা রয়েছে সে ব্যাপারেও সচেতনতা জরুরি। তবে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বিশ্বব্যাপী ডেলিভারি কার্যক্রমে ড্রোন ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এটাই সত্য। আমাজন, গুগল ও ফেসবুকের মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের কাজে ড্রোনকে কার্যকর উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার চিন্তা-ভাবনা করছে। তবে এসব আধুনিকতায় মানুষের জীবনযাপন সহজ হলেও দিন দিন মানুষ যন্ত্রপাতির ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে, যা মানব কল্যাণের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×