
মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি সভ্যতার অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। জন্মগত প্রতিভা যখন সচেতন চর্চা ও প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পদে রূপান্তরিত হয়, তখন তা মেধাসম্পদ নামে পরিচিত। যেমন- কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ তার কাব্যপ্রতিভার একটি অমর সৃষ্টি, যা মেধাসম্পদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই সম্পদ ব্যক্তির সৃজনশীলতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যা হস্তান্তরযোগ্য নয়। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ বা একজন তরুণ সঙ্গীতশিল্পীর নতুন গান- এসবই মেধাসম্পদের উদাহরণ। এই সম্পদ কপিরাইট, পেটেন্ট এবং ট্রেডমার্কের মতো আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে, যা স্রষ্টাকে তাঁর সৃষ্টির ওপর নৈতিক ও আর্থিক অধিকার প্রদান করে।
মেধাসম্পদ শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং সমাজ ও অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মেধাসম্পদের সুরক্ষা ও প্রচার জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই পথে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা মোকাবিলা করে সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানো সম্ভব। মেধাসম্পদ হলো মানুষের মনন থেকে উদ্ভূত সেই সম্পদ, যা সাহিত্য, সঙ্গীত, প্রযুক্তি, শিল্প নকশা বা ট্রেডমার্কের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এটি কোনো সাধারণ সম্পত্তি নয়, কারণ এর উৎস ব্যক্তির সৃজনশীলতা।
বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থা (ডওচঙ) এই অধিকারগুলোকে বিশ্বব্যাপী প্রচার ও সুরক্ষার জন্য কাজ করে। ২০২৫ সালের বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আইপি এবং সঙ্গীত: মেধাসম্পদের তাল অনুভব করুন’ সঙ্গীতের সৃজনশীলতার সঙ্গে মেধাসম্পদের গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরে। এটি বোঝায় যে সঙ্গীতের প্রতিটি সুর, গানের কথা বা রচনা একটি মেধাসম্পদ, যা কপিরাইটের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকা উচিত। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সঙ্গীত ঐতিহ্য- রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, লোকসঙ্গীত বা আধুনিক পপ- এই প্রতিপাদ্যের আলোকে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে মেধাসম্পদের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে মেধাসম্পদের সুরক্ষা ও প্রচার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। আর একটু বিস্তারিত বলা যায়-
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি : শক্তিশালী মেধাসম্পদ আইন উদ্ভাবকদের নতুন পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরিতে উৎসাহিত করে। উদাহরণস্বরূপ- তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তরুণরা বিশ্ববাজারে সফটওয়্যার ও অ্যাপ তৈরি করছে। এই উদ্ভাবনগুলো পেটেন্টের মাধ্যমে সুরক্ষিত হলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রসার : জামদানি, ঢাকাই মসলিন বা ইলিশের মতো ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের নিবন্ধন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ঐতিহ্যের পরিচিতি বাড়িয়েছে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও কপিরাইট সুরক্ষা লোকসঙ্গীত বা আধুনিক গানের বিশ্বব্যাপী প্রচারে সহায়তা করতে পারে।
ছোট উদ্যোগের ক্ষমতায়ন : ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ (ঝগঊ) সৃজনশীলতার ওপর নির্ভর করে। মেধাসম্পদ সুরক্ষা তাদের ব্র্যান্ড ও নকশাকে রক্ষা করে, যা বাজারে প্রতিযোগিতার সুযোগ দেয়।
তরুণ প্রজন্মের মেধা : বাংলাদেশের তরুণরা প্রযুক্তি, সঙ্গীত ও ফ্যাশনের মতো খাতে উদ্ভাবনী ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ, তরুণ সঙ্গীতশিল্পীরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নতুন ধারার গান তৈরি করছেন, যা কপিরাইট সুরক্ষার মাধ্যমে তাদের আর্থিক স্বাধীনতা দিতে পারে।
বাংলাদেশে মেধাসম্পদ সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
বাংলাদেশে মেধাসম্পদের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে গেলে কিছু অন্তরায় অতিক্রম করা জরুরি। নিচে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু প্রতিবন্ধকতা এবং বাস্তবসম্মত সমাধান সংক্ষেপে ও প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করা হলো-
সচেতনতার ঘাটতি
শিল্পী, উদ্যোক্তা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে মেধাসম্পদ অধিকারের (ওচজ) সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান নেই। এর ফলে কপিরাইট লঙ্ঘন, পাইরেসি এবং ব্র্যান্ড চুরি বেড়ে যাচ্ছে।
সমাধান : উচউঞ ও কপিরাইট অফিসের মাধ্যমে স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক কর্মশালা চালু করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা জোরদার করা উচিত। বিশেষ করে সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য কপিরাইট সুরক্ষা বিষয়ে আলাদা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।
আইনি কাঠামোর জটিলতা ও ধীরগতি
পেটেন্ট বা কপিরাইটের নিবন্ধন প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগে, যা স্রষ্টা ও উদ্ভাবকদের নিরুৎসাহিত করে।
সমাধান : নিবন্ধন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজ করে তা আরও সহজ ও দ্রুত করতে হবে। ছোট উদ্যোক্তা ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের জন্য আইনি সহায়তা ও ভর্তুকির ব্যবস্থা থাকা উচিত। মেধাসম্পদ ট্রাইব্যুনালে একটি বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করে মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তি করা জরুরি।
সৃজনশীল শিক্ষার অভাব
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা মুখস্থ নির্ভরতায় আবদ্ধ, যা উদ্ভাবনী চিন্তাকে নিরুৎসাহিত করে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পখাতের সমন্বয় দুর্বল, ফলে গবেষণায় বাস্তবিক প্রয়োগ সীমিত থেকে যায়।
সমাধান : পাঠ্যক্রমে প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং গবেষণা ল্যাবে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সঙ্গীত, প্রযুক্তি ও ডিজাইন শিক্ষায় উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তোলা জরুরি।
নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সীমিত অংশগ্রহণ
নারীদের মেধাসম্পদ ক্ষেত্রে সম্পৃক্ততা এখনো পর্যাপ্ত নয়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও আইনি সহায়তা ও নিবন্ধনের খরচ বহনে পিছিয়ে থাকেন।
সমাধান : নারী উদ্ভাবক ও সৃষ্টিশীলদের জন্য প্রশিক্ষণ, মেন্টরশিপ এবং স্টার্টআপ তহবিলের ব্যবস্থা করা উচিত। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য আইনি পরামর্শ ও সহায়তা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও ডিজিটাল পাইরেসি
বৈশ্বিক উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে। বিশেষত, সঙ্গীত শিল্পে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পাইরেসি ব্যাপক হারে শিল্পীদের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাধান : ডওচঙ-এর সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করে আন্তর্জাতিক মানের ওচজ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে সঙ্গীত ও অন্যান্য সৃজনশীল খাতে কপিরাইট সুরক্ষায় জনসচেতনতা বাড়ানো এবং ডিজিটাল পাইরেসি রোধে প্রযুক্তিগত ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মেধাসম্পদ কোনো নিছক আইনি পরিভাষা নয়। এটি একজন স্রষ্টার চিন্তা, শ্রম ও কল্পনার বহির্প্রকাশ, যা সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার প্রেরণা যোগায়। বাংলাদেশের প্রতিটি মেধাবী তরুণ, সৃষ্টিশীল নারী, গ্রামীণ কারুশিল্পী কিংবা ডিজিটাল সঙ্গীতশিল্পী- সবাই মিলে তৈরি করছেন একটি সৃজনশীল পরিমণ্ডল, যা সঠিকভাবে সুরক্ষিত হলে অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক পরিচয়ে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। তাই প্রয়োজন, একটি সুদৃঢ় ও সমন্বিত মেধাসম্পদ নীতির, যা উদ্ভাবকদের প্রেরণা জোগাবে, শিল্পীদের সম্মান দেবে এবং জ্ঞাননির্ভর সমাজ গঠনের ভিত মজবুত করবে। আসুন, আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়ি- যেখানে প্রতিটি সৃষ্টি হোক মর্যাদাসম্পন্ন, প্রতিটি মেধা হোক জাতির সম্পদ, আর সুরক্ষিত মেধাসম্পদ হোক আমাদের টেকসই উন্নয়নের চালিকাশক্তি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ
প্যানেল