
সড়ক দুর্ঘটনা দেশের এক নিত্যনৈমিত্তিক নিদারুণ যন্ত্রণা। কত মানুষের জীবন বিপন্ন হয় তাও নিতান্ত দুর্বিষহ বাতাবরণ। শুধু একজন ব্যক্তির জীবনহানিই নয়, বরং পুরো পরিবারের ওপর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার দুরবস্থা। বিপর্যস্ত পরিবার পড়ে যায় চিরস্থায়ী দুর্ভোগ, দুর্যোগের কঠিন যাত্রাপথে। যার হিসাব মেলানো আর এক রুদ্ধতার বেষ্টনী। তবুও থামানো যাচ্ছে না এমন নৃশংস লোমহর্ষক অঘটন। পরিবেশ পরিস্থিতিও নির্মম পেষণ বলাই যায়। নিয়মিত পথ দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্তে উঠে আসছে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার অপদৃশ্য। আমরা ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের ক্রান্তিকালীন সময় অতিক্রম করছি। গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী মার্চ মাসেই ৫৯৩ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় ৬১২ জনের। নিত্য নতুন অবকাঠামোর সুরম্য লীলা নিকেতনে দেশটি এখন উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের যাত্রা পথ পাড়ি দিচ্ছে। পাশে থাকছে হরেক বিপরীত স্রোতের জ্বালাময়ী আখ্যান। গোটা মার্চ মাসের পথ দুর্ঘটনায় আহত ১২৪৬ জনের অনেকেই কর্মক্ষমতা হারানো ছাড়া বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে দুর্বিষহ কাল অতিক্রম করা অস্বস্তিকর। সার্বিক দেশের জন্যও কোনো মঙ্গলবার্তা বয়ে আনে না। সড়ক দুর্ঘটনায় এগিয়ে থাকে ছোট্ট যন্ত্রযান মোটরবাইক। সড়কের যাত্রী কিংবা পথচারীরা জানেন কিভাবে এই ছোট্ট যানটি কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। আর দুর্ঘটনায় চিহ্নিত জায়গাটি হলো রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়ক পথে। আর নদী-নালা-খাল এই নিয়ে বরিশালÑ সেখানে হয়েছে সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা। কারণ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বরিশালে যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমই হলো লঞ্চ কিংবা স্টিমার। নদী কিংবা সমুদ্রপথের যাত্রা নিরাপদই শুধু নয় তার চেয়ে বেশি আরামদায়ক স্বস্তিকর। সমুদ্র ও নদী পরিবেষ্টিত আবহমান বাংলার চিরস্থায়ী যাত্রী পারাপারের অভাবনীয় মাধ্যম স্টিমার এবং লঞ্চ। যেখানে কোনো পথের ক্লান্তি নেই। যানজটের আশঙ্কা থাকেই না। আহারেও থাকে এক স্বস্তিকর পরিবেশ। তবে উন্নয়ন অবকাঠামোর ক্রমাগত বিস্তারে এমন নদি সমুদ্র বিহার আগের মতো আর নেই। সময় স্বল্পতায় দূর-দূরান্তের বাস, ট্রেন কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি বহরে দেশের এক স্থান থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত কিংবা ভ্রমণ সত্যিই দেশের কর্মচাঞ্চল্যের আর এক যাত্রায় শামিল হচ্ছেন সিংহভাগ মানুষ। তার ওপর বহুমুখী পদ্মা আর যমুনা সেতুর আধুনিক মাত্রার যে নব সংযোজন তাও যাত্রাপথের নবতর সৃষ্টি বলাই যায়। সেখানে আবার অন্য মাত্রার বিপত্তি। নদীর নাব্যতা আর পানি কমে যাওয়াও নাকি হরেক অব্যবস্থাপনার শিকার। নদী ভরাট করে বিভিন্ন বহুতল ভবন কিংবা কর্ম সংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। নদীমাতৃক আবহমান বাংলার ভিন্নমাত্রার কর্মযোগই বটে।
তবে পথ দুর্ঘটনায় ব্যক্তি আর পরিবারের ওপর দুর্ভোগ নেমে আসা সেটা কোনো সহনীয় বিষয় নয়। যে মানুষটি চলে যান তার স্মৃতিকাতরতায় পুরো পরিবারকে যে মাত্রায় বিপন্ন্নতার শিকার হতে হয় তাও বিষণ্নতার দগ্ধ পরিবেশ। গণমাধ্যমের খবরে দৃশ্যমান হয় রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স যদি এমন অসহনীয় দুর্বিপাকের সম্মুখ সমরে পরে যায় তা হলে পথেই মৃত্যু ঠেকানোই মুশকিল। কারণ হিসেবে কত অব্যবস্থাপনা সামনে চলে আসে। সবার আগে দৃশ্যমান হয় সড়ক পরিবহন আইনকে তোয়াক্কা না করা। ট্রাফিক সিগন্যালকে মান্যতা না দেওয়া। তার ওপর আছে সামনের গাড়িকে টেক্কা দিয়ে আগে চলে যাওয়া। সড়কে কত কিলোতে গাড়ি চালাতে হবে তাও নির্ধারণ করা আছে নির্দিষ্ট আইনি বিধানে। বিভিন্নভাবে দায় ভাগ গিয়ে পড়ে অদক্ষ চালক ত্রুটিপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থাপনার চরম গাফিলতি। হরেক কোম্পানির বৃহৎ যন্ত্রযানগুলো চালক, গতি নিয়ন্ত্রণ এবং সংশ্লিষ্ট আইনি নিয়ম রক্ষায় সুশৃঙ্খলভাবে কোনো কিছুই পরিস্থিতির আয়ত্বে থাকে না বলে তথ্য-উপাত্তে বারবারই নির্দেশিত হয়েছে।
আবার সড়ক মহাসড়ক ব্যবস্থাপনার হরেক দৃষ্টিকটু আলামতও সময়-অসময়ে প্রকাশ পাচ্ছে। ট্রাফিক আইন শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়-দায়িত্ব নয়। তার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন থাকবে চালকের দক্ষতা, আইনানুগ বিধি অনুসরণ করা এবং নিজের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আয়ত্বে আনা। সব দুর্ঘটনা কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা চালকের অদক্ষতা নয় বরং সংশ্লিষ্ট সড়কটির চারপাশও দুর্ঘটনাকে উসকে দেয় বলে বিভিন্নভাবে উঠে আসে। বিশেষ করে পথচারী পারাপারে। যার জন্য নির্দিষ্ট সঙ্কেতপূর্ণ জায়গা নির্ধারিত করা থাকে। যেখানে অনেক দায়বদ্ধতা থাকে পথচারীর ওপর। ফলে দুর্ঘটনার আলামত বিচার-বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয় পথচারীরা নিজেরাও জানে না সড়ক পরিবহন আইনের মূল নিয়মটি কি? অজ্ঞতা, উদাসীনতা, রাস্তা পারাপারে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হওয়া ও দুর্ঘটনাকে বিভিন্ন সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। সত্যিই অন্য এক অসহনীয় দুর্বিপাক। সচেতন সাবধানতাও বিশেষ জরুরি। অসতর্ক মুহূর্তে কত অরাজক ব্যবস্থাপনা মানুষের জীবনহানির কারণ হতে পারে তেমন ঘটনাও পরিস্থিতিকে সম্মুখ সমরে নিয়ে যায়। পথচারী যদি তার পাশের সেতুটি ব্যবহার না করে সময় বাঁচানোর জন্য সড়ককে বেছে নেয় সেটাও কোনোভাবেই গ্রহণীয় হয় না। সময়ের চাইতে জীবনের দাম অনেক বেশি। বারবার সতর্ক বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। দুর্ঘটনা কমাতে শুধুমাত্র সড়ক পরিবহন আইনই যথেষ্ট নয়, আরও বিভিন্ন কার্যক্রমও ভাবনার মধ্যে জাগিয়ে রাখা নিতান্ত জরুরি। বলা হচ্ছে, দক্ষ প্রশিক্ষণ ও সনদপ্রাপ্ত চালকদের দিয়েই ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ যান বাহন চালানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে। পথচারী যদি অসাবধান হন তা হলে সবার আগে নিজের জীবনটাই শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমরা যারা নিয়মিত রাস্তাঘাটে চলাচল করি দেখা যায় বিভিন্ন লাল-সবুজ সংকেতবাতি সেভাবে জ্বলে না। এর উত্তরও খুঁজে পাওয়া যায়। সংকেত চিহ্ন হয়তো বা অব্যবস্থাপনার শিকার। নতুবা লাল-সবুজ আলোটি জ্বালানোর অনুপযোগী কি না তাও খতিয়ে দেখা পরিস্থিতির ন্যায্যতা। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় সেখানে ব্যবস্থাপনার যথেষ্ট নজরদারি অব্যাহত রাখাও দুঃসহ পরিস্থিতিকে কিছুটা হলেও সামলানো। সবচেয়ে প্রয়োজন যা তা হলো দক্ষ চালক সঙ্গে সড়ক পরিবহন আইনটির যথাযথ প্রয়োগ। আর পথচারী সেতু ব্যবহার আর এক অবশ্য পালনীয় বিষয়। তবে সচেতন সাবধানতার বিকল্প অন্য কিছু নয়। দক্ষ চালক বিশেষ করে নৈশ কোচের হঠাৎ করে ঝিমুনির আবর্তে অসচেতন হয়ে গেলে পরিস্থিতি সামলানো বিপত্তির কবলে পড়ে যায়। কারণ যে কোনো যন্ত্রযানের পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকে চালকের। ক্ষুদ্র কিংবা বৃহদাকার যাই হোক না কেন। আবার ক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়াও পরিবহন আইনের আওতায় পড়েই না।
প্যানেল