
সবুজ অর্থায়ন হলো এমন একটি ঋণ বা বিনিয়োগ যা পরিবেশবান্ধব কার্যকলাপকে সমর্থন করে। যেমন- পরিবেশবান্ধব পণ্য ও পরিষেবা কেনা বা পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো তৈরি করা। পরিবেশবান্ধব হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারা এবং ব্যবসায়িক পরিবর্তন করা ব্যয়বহুল হতে পারে। তাই সবুজ অর্থায়নে প্রায়ই এমন প্রণোদনা অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে, যা বৈদ্যুতিক যানবাহনে স্যুইচ করার খরচ কমিয়ে নিয়ে আসতে পারে। তাই এটি মানুষ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবেশ- উভয়ের জন্য ভালো ক্রয় এবং বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে পারে। সবুজ অর্থায়ন সত্যিকার অর্থে মূলধারায় সম্পূর্ণভাবে এবং কার্যকরভাবে প্রবেশ করাতে হবে। পরিবেশগতভাবে ক্ষতিকারক পণ্য এবং পরিষেবার সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আমরা আশা করতে পারি যে সবুজ বিকল্পগুলোতে ক্রয় এবং বিনিয়োগ আদর্শ হয়ে উঠবে। ব্যাংক ক্রমবর্ধমানভাবে বায়ু এবং সৌর খামারের মতো সবুজ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য আরও সবুজ অর্থায়ন উপলব্ধ এবং অ্যাক্সেসযোগ্য করে তুলছে। ব্যবসাকে আরও সবুজ করে তুলতে সহায়তা করার জন্য নিজেরাই বিনিয়োগ করছে। তাই পরিবেশবান্ধব কার্যকলাপকে সমর্থন করার জন্য মানুষ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে অর্থ অ্যাক্সেস করতে সহায়তা করার ক্ষেত্রে ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কম কার্বন অর্থনীতিতে রূপান্তরকে সমর্থন করার জন্য সবুজ অর্থায়নের গুরুত্ব জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে স্বীকৃত হয়েছে, যেখানে বিশ্বনেতারা গ্রহকে রক্ষা করার পরিকল্পনায় একমত হন। প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ২১ এ বিভিন্ন দেশের সরকার প্রাক-শিল্প স্তরের তুলনায় বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে- বিশেষ করে ১.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে সম্মত হয়েছিল, যা খুবই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ছিল। তবে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আমরা এই লক্ষ্য অর্জনের পথে নেই। আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি হলো কম কার্বন ভবিষ্যতের সমাধানের জন্য অর্থায়নের অভাব। জলবায়ু অর্থায়ন হলো সবুজ অর্থায়নের একটি উপসেট। এটি মূলত পাবলিক ফাইন্যান্সকে বোঝায়। অথবা যেখানে উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন উৎসের মাধ্যমে অর্থায়ন প্রদান করে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বহুপক্ষীয় প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করে। সবুজ অর্থায়ন একটি বিস্তৃত শব্দ, যা টেকসই পরিবেশগত লক্ষ্যকে সমর্থন করে এমন সমস্ত আর্থিক প্রবাহকে অন্তর্ভুক্ত করে।
তিনটি ভিন্ন ধরনের সবুজ অর্থায়ন রয়েছে- সবুজ বন্ধক, সবুজ ঋণ, সবুজ ব্যাংক। সবুজ ব্যাংক গতানুগতিক ব্যাংকের মতোই কাজ করে। তবে তারা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি এবং অন্যান্য পরিবেশবান্ধব উদ্যোগে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য পাবলিক তহবিল নিয়োগ করে। ২০২০ সালের এক গবেষণা অনুসারে, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবুজ ব্যাংকের সংখ্যা এক থেকে বেড়ে ২০টিতে দাঁড়িয়েছে, যারা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা দেশের জলবায়ু ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জলবায়ু-নিরপেক্ষ অর্থনীতিতে রূপান্তরের জন্য অর্থায়নের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তহবিল আকর্ষণ করা প্রয়োজন, যা সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি। যার জন্য বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন যাদের জন্য নতুন সুযোগ উন্মুক্ত হচ্ছে। তাছাড়া সবুজ আর্থিক পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কম কার্বন অর্থনীতিতে রূপান্তর একটি প্রতিশ্রুতিশীল দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সুযোগ, যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবুজ অর্থায়ন বজায় রাখতে সক্ষম। অতএব সবুজ অর্থায়নের সুযোগ, নতুন শ্রেণিবিন্যাস এবং মান অন্বেষণ একটি কেন্দ্রীয় উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের কৌশলে সবুজ তহবিল অন্তর্ভুক্ত করে একাধিক সুবিধা উপভোগ করতে পারে। প্রথমত, সাম্প্রতিক বছরে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে, পরিবেশ সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাসের ওপর কার্যক্রমকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য তাদের একটি ভালো ভাবমূর্তি থাকতে পারে। যা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকার, গ্রাহক এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে খ্যাতি এবং বিশ্বাসযোগ্যতা উন্নত করতে সম্পর্ক উন্নত করতে অবদান রাখবে। পরিবেশগত ঝুঁকির বোঝাপড়া এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার কারণে এসব উন্নতি সম্ভব হয়েছে। এটি নতুন বাজারে প্রবেশাধিকার সহজ করতে পারে, প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা প্রদান করতে পারে অথবা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনুভব করার কারণে বাজারে পরিবর্তনের প্রতি স্থিতিস্থাপকতা উন্নত করতে পারে। নতুন গ্রাহক পছন্দের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচন করে। উপযুক্ত মাঝারি এবং দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করে। আরেকটি সুযোগ হতে পারে পরিবেশগত ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত সম্পদের ভাগ হ্রাস করে পোর্টফোলিও ঝুঁকি বৈচিত্র্যকরণ করা, যা কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন নিয়মকানুনের (‘সবুজ’ সম্পদের ওপর ভিত্তি করে মূলধনের প্রয়োজনীয়তা) জন্য প্রস্তুত করতে পারে। সবুজ তহবিল নতুন গবেষণা এবং বিশ্লেষণের জন্য একটি সুযোগ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি সূচক ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, ১৭০টি দেশের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। কারণ, বন্যা, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বাংলাদেশের সবচেয়ে কম। এছাড়াও বাংলাদেশ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কারণ, বর্তমান দারিদ্র্যের হার ৩১.৫ শতাংশ। তা সত্ত্বেও দেশটি সম্প্রতি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে। এর মূল লক্ষ্য হলো কৃষির টেকসই বৃদ্ধি, শিল্প প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ এবং এফডিআই আকর্ষণ করা। আর্থিক ব্যবস্থাকে সবুজ করা প্রবৃদ্ধির পথের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ পরিমাপের একটি নির্ধারক হবে। প্রধান খাতকে পরিবেশগতভাবে দায়ী উৎপাদনে সবুজ রূপান্তর নির্ভর করবে টেকসই অর্থায়নের দিকে বেসরকারি খাতের অর্থায়নকে কতটা সক্রিয়ভাবে পরিচালিত এবং তত্ত্বাবধান করে তার ওপর। ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি শেয়ার এবং বন্ড থেকে তহবিলকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে বেসরকারি খাতে সবুজ অর্থায়নকে কাজে লাগানো যেতে পারে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে তাদের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে একটি মানসম্মত বিন্যাস বজায় রেখে সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রকাশ প্রকাশ করার জন্য একটি সাধারণ দিকনির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখলে বাজার সূচকের বিভিন্ন রেটিংয়ের মাধ্যমে তাদের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। এভাবে বেসরকারি খাতের কোম্পানি তাদের বিনিয়োগের প্রভাবের জন্য দায়ী থাকবে। এটি সরাসরি সবুজ অর্থায়নের জন্য একটি নতুন সুযোগ তৈরি করবে। কারণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আরও উৎসাহিত হবে। নতুন শেয়ার ইস্যু করে এবং সবুজ বন্ড প্রবর্তন করে, বাংলাদেশ পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের মাধ্যমে কম কার্বন প্রকল্পের ঝুঁকি কমাতে পারে।
বাজার উদ্ভাবনের বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর সবুজ অর্থায়নের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রয়েছে। সবুজ এবং টেকসই শিল্পের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির চাহিদা তৈরি করা সম্ভব, যা সবুজ অর্থায়নের দিকে পরিচালিত করে। সবুজ অর্থায়নের মাধ্যমে উৎপাদন শিল্পের জন্য প্রণোদনা প্রবর্তন করলে পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের উদ্দীপনা আসতে পারে, যা পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাস করে। একটি সহায়ক আর্থিক ব্যবস্থা কেবল পরিবেশবান্ধব রূপান্তর গ্রহণ করে একটি টেকসই খাতের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত নারী উদ্যোক্তাদের ওপর গুরুত্বারোপ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) সমর্থন করার জন্য ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। উদীয়মান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে, বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু আর্থিক উপকরণ চালু করেছে যেমন- ক্রেডিট হোলসেলিং, ঋণ গ্যারান্টি, উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তহবিল ব্যবহার এবং ছাড়মূলক তহবিল সরবরাহের মাধ্যমে পুনঃঅর্থায়ন ইত্যাদি। সামগ্রিক অর্থনীতিকে সবুজ করার জন্য, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত এই উদ্যোগ সহায়তামূলক অর্থায়ন প্রকল্পের অবদান নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এসএমই অর্থায়ন সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য, বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি অগ্রাধিকার খাতের একটি তালিকা চালু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন; পাটজাতপণ্য, চামড়াশিল্প, প্লাস্টিকশিল্প, কৃষিপণ্য এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি।
সবুজ অর্থায়নের সাফল্য সম্ভাব্য খাত অন্বেষণ, উপযুক্ত পরিকল্পনা এবং কৌশল ডিজাইনের ওপর নির্ভর করে। পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের জন্য, তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য খাতগুলো চিহ্নিতকরণ এবং মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে। তবে চিহ্নিত সম্ভাব্য ক্ষেত্র হলো- নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি, জ্বালানি দক্ষতা এবং পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন। যদিও সবুজ ব্যাংকিং নীতি নির্দেশিকা ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করেছে। তবু উন্নতি সীমিত হয়েছে, যা সবুজ অর্থায়নের ধীর প্রবৃদ্ধি থেকে স্পষ্ট। এছাড়াও সবুজ অর্থায়ন বৃদ্ধির জন্য মূলধন বাজার, শিল্প অংশীদার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সেক্টর স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সক্ষমতা বিকাশ প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবুজ ব্যাংকিং নীতি-নির্দেশিকা মোট ঋণ পোর্টফোলিওর অনুপাত হিসেবে সরাসরি সবুজ অর্থায়নের জন্য ন্যূনতম ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আজ অবধি ৫০টি খাতকে সরাসরি সবুজ অর্থায়নের জন্য যোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরাসরি সবুজ অর্থায়ন পাওয়ার জন্য যোগ্য হিসেবে চিহ্নিত খাতগুলোতে সাধারণত অল্প পরিমাণে তহবিলের প্রয়োজন হয়। এই ৫০টি খাতে অসংখ্য মাঝারি ও বৃহৎ আকারের খাতে মোট ঋণের ৫ শতাংশ বিতরণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি কঠিন লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে প্রমাণ হয়েছে। সে অবস্থায় পরিবেশবান্ধব প্রকল্প এবং বিনিয়োগকে সমর্থন করে একটি টেকসই, কম কার্বন অর্থনীতি অর্জনের জন্য সবুজ অর্থায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করতে সহায়তা করে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
প্যানেল