ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ও টেকসই গণতন্ত্র

মো. রবিউল ইসলাম কবি ও লেখক

প্রকাশিত: ২১:৫৮, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ও টেকসই গণতন্ত্র

মো. রবিউল ইসলাম কবি ও লেখক

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৫৪ বছর। দিন-ক্ষণ বিবেচনায় রাষ্ট্রের জন্ম খুব কম সময় হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে ব্রিটেন, ভারত বা আমেরিকার ইতিহাসের সঙ্গে তুলনা করলে, বাংলাদেশ এখনো একটি শিশু রাষ্ট্র।

তারপরও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় ৫৪ বছর একেবারে কম সময় নয়। বাংলাদেশের মাটি অত্যন্ত উর্বর। দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ কৃষক। কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে কৃষিতে দারুণ সাফল্য দেখিয়ে মানুষের খাদ্যের যোগান দিয়ে আসছেন।প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে।

তবে অত্যন্ত দুঃখজনক যে, বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে সবসময় কালো মেঘ জমে থাকে। কখনো তা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ফলে আমরা একটানা গণতান্ত্রিক ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছি। কখনো সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটেছে, আবার কখনো রাজনৈতিক দলগুলোর স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এর ফলে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাহত হয়েছে।

স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়েছিল। দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় প্রবেশ করলেও, বেশিদূর এগোতে পারেনি। মাগুরার উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্দোলন-সংগ্রামের মুখে ১৯৯৬ সালে চালু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কিছুটা হোঁচট খেলেও দেশে মোটামুটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় ছিল। ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়। এরপর ২০১৪ সাল থেকে দলীয় সরকারের অধীনে বিতর্কিত নির্বাচন হতে থাকে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে। উন্নয়নের কথা বলে গণতন্ত্রকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়।

আমাদের বড় ব্যর্থতা হলো—গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও শক্তিশালীভাবে গড়ে তুলতে পারিনি। প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময় সরকারি দলের অনুগত হিসেবে কাজ করেছে। এর ফলে দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়নি।

অতীতের ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও, সেগুলো হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এটি রাজনৈতিক দল ও নেতাদের ব্যর্থতা—কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। বিশ্বের কোথাও, পাকিস্তান ছাড়া, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার নজির খুব কম পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় সমস্যা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারের কথা বলে ক্ষমতায় এসে দীর্ঘদিন থেকে যেতে চায়। ২০০৭ সালের অভিজ্ঞতা তার প্রমাণ। অন্যদিকে, রাজনৈতিক সরকারও উন্নয়নের অজুহাতে মানুষের ভোটাধিকার খর্ব করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়।

উন্নয়ন বা সংস্কারের এই বয়ান দেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ফলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন টেকসই গণতন্ত্র। অর্থাৎ, নিয়মিত নির্বাচন ও মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। তবেই গণতন্ত্রের দ্বার উন্মুক্ত হবে। এর জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে এবং দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

দলীয় সরকারের অধীনে ভোট কারচুপি বন্ধ করতে হবে। অতীতে আমরা দেখেছি—

  • অস্বাভাবিক ভোটার টার্নআউট,
  • ব্যালট বাক্স ছিনতাই,
  • বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ গঠন,
  • রাতের বেলায় ভোট,
  • একক দলের ভেতরে ডামি নির্বাচন।

এ থেকে স্পষ্ট, দলীয় সরকারের অধীনে এখনো সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

তবে ভবিষ্যতের জন্য আমাদের টেকসই গণতন্ত্রের লক্ষ্যে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে হবে। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ এলে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

টেকসই উন্নয়ন শুধু অবকাঠামোগত নয়; এর সাথে মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার, স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনও জরুরি।

রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে—কিভাবে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে। সঠিক নির্বাচনের রাস্তা রাজনীতিবিদদেরই খুঁজে বের করতে হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে চিরতরে বিদায় জানাতে হবে। কারণ, এটি রাজনীতিবিদদের জন্য অপমানজনক। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মাইনাস থিওরি প্রয়োগের চেষ্টা করেছে, নিজেরা ‘কিংস পার্টি’ গঠন করেছে, যা জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার পারিবারিক রাজনীতির অবসান ঘটাতে চাইলেও, এ অঞ্চলে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও পারিবারিক রাজনীতির দৃষ্টান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ছাড়াও অনেক ছোট দলেই দীর্ঘদিন ধরে একই নেতৃত্ব রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারতসহ উন্নত দেশগুলোতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় এবং প্রশ্ন ওঠে না। ফলে তারা উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা পারছি না।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মূল বাধা হলো, সময়মতো নির্বাচন না হওয়া এবং মানুষকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। তাই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ তৈরি করতে হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার দীর্ঘ মেয়াদে চালু থাকলে দেশ ‘বিরাজনীতিকরণ’-এর দিকে যাবে, যা বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট ডেকে আনবে। তখন গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়বে। এটি হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

সুতরাং, রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই হবে টেকসই গণতন্ত্রের একমাত্র পথ।

এসএফ 

×