ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

পেহেলগাম ট্র্যাজেডি ও নতুন রসায়নে রাজনীতি

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ২১:২০, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

পেহেলগাম ট্র্যাজেডি ও নতুন রসায়নে রাজনীতি

ভারতের ভূস্বর্গখ্যাত জম্মু কাশ্মীরের নৈসর্গিক শহর পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর জঙ্গি হামলার ঘটনায় ২৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এবং ৩০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। গত ২২ এপ্রিল আচমকা এ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। ঘটনার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সৌদি আরবে সফররত ছিলেন। সফর সংক্ষিপ্ত করে তিনি দিল্লি ফিরে আসেন। নিহতের মধ্যে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর এক কর্মকর্তা ও এক গোয়েন্দা কর্মকর্তাও রয়েছেন। দুইজন বিদেশী পর্যটকও এ হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। পেহেলগাম মনোমুগ্ধকর পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। একটি রিসোর্টের ফটক ডিঙিয়ে বন্দুকধারী একদল লোক পর্যটকদের ওপর গুলি করতে থাকে। তাদের হামলাটি ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। কোনো নারী পর্যটকদের ওপর আঘাত করা হয়নি। পুরুষদের লাইনে দাঁড় করিয়ে অনেক কাছ থেকে বুকে গুলি করা হয়। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়, বিশেষ ধর্ম অর্থাৎ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়। বিদেশী দুই নাগরিককে ইহুদি সন্দেহে খুন করা হয়। এ ঘটনায় গোটা পৃথিবীতেই সোরগোল পড়ে যায়। বিশ্ব নেতারা নিন্দা জানাতে শুরু করেন এবং নিহতদের আত্মার সদগতি ও শোকবিহ্বল পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করেন। কিন্তু এ বিবৃতি তো নিহতদের জীবন ফিরিয়ে দেবে না। যারা স্বজন হারিয়েছেন বেদনার ভার বহন করতে হবে তাদেরই। ক্ষতিও মেনে নিতে হবে প্রকৃতির বিধান অনুসারে।
পেহেলগামের এ হামলার ঘটনায় ভারত সরকার পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে দেশটি। ‘দ্য রেজিস্টান্স ফ্রন্ট’ নামের’ একটি সংগঠন এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। ২০১৯ সালে স্বল্প পরিসরে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটে, যার সংক্ষিপ্ত নাম ‘টি আর এফ’। সাধারণত জঙ্গি সংগঠনগুলোর বেশির ভাগই ইসলাম পরিচয়ে পরিপুষ্ট থাকে। কিন্তু ‘টি আর এফ’ এর ব্যতিক্রম। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি তৈরির উদ্দেশ্যেই ইসলাম শব্দ ভাবাপন্ন শব্দটিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দারা মনে করেন এটাও ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের আর একটি রূপ। পাকিস্তান এর ইন্ধনদাতা। ঘটনার আড়ালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে বলেই ভারতের দাবি। সেজন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ভারত। সিন্ধুনদের পানিবণ্টনের ঐতিহাসিক চুক্তি স্থগিতসহ আরও পাঁচটি বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ভারত। যেমন- সিদ্ধান্ত গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানিদের ভারত ছাড়ার নির্দেশ, কিছু পাকিস্তানি কূটনীতিককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা সমন্বিত আটারি চেকপোস্ট বন্ধ ঘোষণা, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বিনা ভিসা প্রকল্প বন্ধ ঘোষণা ইত্যাদি।
পাকিস্তানও কূটনৈতিকভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে, ভারত-পাকিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্কে টানপোড়েনের নতুন মাত্রা যোগ হলো। যদিও ভারতে জঙ্গি হামলা এটাই প্রথম নয়। ২০০৬ সালে মুম্বাইয়ের শহরতলিতে রেলওয়েতে ১১ মিনিটের মধ্যে সাতটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হয়। সেই বোমা হামলায় ২২ বিদেশীসহ ২০৯ জন নিহত হয়েছিল। আহতদের সংখ্যা ছিল সাতশ’র বেশি। ইতিহাসে সেটি ছিল এক ভয়ংকর হামলা। মুম্বাই পুলিশের মতে, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি) এবং স্টুডেন্টস্ ইসলামি মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া (সিসি) ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলসহ কয়েকটি জায়গায় ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। সে ঘটনা সরাসরি পাকিস্তান থেকে আসা জঙ্গিরা ওই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। হামলায় ১৬৪ জন প্রাণ হারান। এর মধ্যে ৩০ জন ছিলেন বিদেশী নাগরিক। সে সময় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়- তার নাম কাসেম। ২০১২ সালে তার সাজা কার্যকর হয়। ২০০১ সালে দিল্লির ভারতীয় সংসদে বহুল আলোচিত হামলার ঘটনা ঘটে। সেই হামলায় একজন সাধারণ নাগরিকসহ ১২ জনের মৃত্যু ঘটে। লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জৈস-ই-মহম্মদ নামের জঙ্গি সংগঠন ওই হামলায় অংশ নেয়। এছাড়াও আরও অনেক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে ভারতে। কেবল ভারত নয়, উপমহাদেশের বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালেও জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
ইউরোপ-আমেরিকাতেও জঙ্গি হামলার ইতিহাস রয়েছে। বিশ্বের আলোচিত জঙ্গি নেতা ওসামা বিন-লাদেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা হয়। সে হামলায় প্রায় সাত হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। জঙ্গি হামলার ইতিহাস অনেক লম্বা। সে ইতিহাস ঘেঁটে কোনো লাভ নেই। জঙ্গি হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতির রসায়ন সময়ের ব্যবধানে বদলে যায়। মূলত জঙ্গি হামলার গভীরতা বিশ্লেষণ করলে একটা জিনিস প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চকে আলোড়িত করার লক্ষ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি এবং তাদের ব্যবহার করা হয়। হামলায় প্রাণ যায় নিরীহ মানুষের। রাজনীতির রসায়নে সংযুক্তি ঘটে নতুন বিস্ফোরক দ্রব্যের। এতে কার লাভ হয়? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কখনো বিশ^ নেতৃত্ব প্রস্তুত ছিল না। এখনো প্রস্তুত নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশে^র সকল দেশের নেতাই জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে কথা বলেন। ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গি মোকাবিলার কথাও জনগণের কর্ণকুহরে বাজে। প্রতিবছর জাতিসংঘের অধিবেশনে বিশ্ব নেতাদের মিলনমেলা ঘটে। শান্তির ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে জাতিসংঘ ও বিশ্ব। সন্ত্রাস দমন সৃষ্টকৃত অপরাধ দমনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়। কিন্তু দিন শেষে বিশ্বের মানুষ কেবল অশান্তিই দেখে। মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, রেষারেষি, যুদ্ধ দামামায় বিশ্বকে রাখা হয় সদা ব্যস্ত। সকল নেতা ঐক্যবদ্ধ থাকলে সন্ত্রাস, জঙ্গি কেন মাথা চারা দেবে? সন্ত্রাস ও জঙ্গি কার্যক্রমকে কেন্দ্র করেই রাজনীতির নতুন নতুন প্রাচীর গড়ে ওঠে। যে প্রাচীর ভাঙতে হবে সাধারণ মানুষকে।
সন্ত্রাসের জন্ম হয় কোথা থেকে কিংবা জঙ্গিবাজের জন্ম হয় কোথা থেকে? এর একটি সহজ উত্তর হতে পারে, ক্রোধ থেকে। সেটা হতে পারে কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতার ক্রোধ কিংবা কোনো দর্শন প্রবর্তকের ক্রোধ? এটা কোনো না কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করবেই। ক্রোধ দমন খুবই কষ্টসাধ্য বিষয়। কিন্তু এর জন্য চাই মনের প্রশিক্ষণ। প্রথমে আমরা ক্রুদ্ধ হই, কিছু পরেই আবার ঠান্ডা হয়ে যাই। তারপর আমাদের চিন্তা করতে হবে- কেন ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম? কেন সংযম হারিয়েছিলাম? এখন আবার চেষ্টা করব। এভাবে যদি আমাদের রাজনৈতিক নেতারা চিন্তা করতেন, তবে বিরোধ কারও সঙ্গে হতো না। সমস্যাও মিটে যেত। রাজনীতি, সমাজনীতি ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা ৪০/৪৫ বছর আগে শুধু জাতীয় সমস্যা ছিল; এখন আর জাতীয় ভিত্তিতে সেগুলোর সমাধান করা যায় না। সমস্যাগুলো ক্রমশ বিশাল আকার ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক ভিত্তিরূপ প্রশ্বস্ততর ভূমি থেকেই শুধু এগুলোর মীমাংসা করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি, আন্তর্জাতিক সংঘ ও আন্তর্জাতিক বিধান- এ হচ্ছে বর্তমান সময়ের মূলমন্ত্র। এ মূলমন্ত্রকে যদি সত্যজ্ঞানে বিবেচনায় নেওয়া যায়, তবে সমস্যার সমাধান হতে পারে।
পৃথিবীতে এখন যুক্তরাষ্ট্র একক পরাশক্তি দেশ। আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে গালিগালাজ করি, হিংসা করি। বিশ্বে যুদ্ধ ও অশান্তির জন্য দায়ী করি। কিন্তু দিন শেষে আমেরিকান নীতির দিকে লক্ষ্য রাখি। আমেরিকা আমার প্রতি কতটা উদার, কতটা অনুকম্পা লাভ করতে পারি, এ যেন এক প্রতিযোগিতা। কালের পরিক্রমায় কে কার বন্ধু হবে সেটা বলা বড় মুশকিল। প্রত্যেক নেতা যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে বন্ধুসুলভ হয়ে মনুষত্ব বিকাশের আহ্বান জানায়, তবে জঙ্গিরাও লজ্জায় লুকাবে। মনুষত্বের ওপর কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে সম্মিলিতভাবে। বিশ্ব আজ রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এ পরিস্থিতিতে রাজনীতিকে নতুন রসায়নে বিকিরণ ঘটিয়ে এক বিশ্বনীতি প্রণয়ন করতে হবে। যেটা হবে সকল দেশের সংবিধান। বর্তমান রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র যেন পরস্পর সম্পর্কিত- এই তত্ত্বের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এক সময় ছিল পরস্পরে শত্রু। ভারত-পাকিস্তান কিংবা চীন-ভারত সন্ত্রাসী এই তত্ত্বকে অনুসরণ করবে, এ প্রত্যাশা রাখি। এই তত্ত্বে পৃথিবী বিকশিত হলে কোথাও জঙ্গি বা হামলার ঘটনা ঘটবে না। মনুষত্বের জয় হবে। মানব জাতির কল্যাণে বাসযোগ্য অভিন্ন পৃথিবী চাই- এ স্লোগান ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

প্যানেল

×