
মানব সভ্যতা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। যা একসময় অপসংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়, কালের প্রবাহে তা মূলধারার সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। আমাদের চারপাশে তাকালে আমরা দেখতে পাই, অতীতে যেসব বিষয় সমাজে গ্রহণযোগ্য ছিল না, আজ তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তন কি উন্নতির দিকেই যাচ্ছে, নাকি সমাজকে ধীরে ধীরে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?
অপসংস্কৃতি বলতে সাধারণত আমরা এমন সংস্কৃতিকে বুঝি যা প্রচলিত নৈতিকতা ও সামাজিক রীতিনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। এটি মূলধারার সংস্কৃতিকে বিকৃত করে দেয়, কখনো কখনো সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেক অপসংস্কৃতি একসময় প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতির অংশ হয়ে গেছে।
গণমাধ্যম ও বিনোদন শিল্পের প্রভাব অপসংস্কৃতির বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টেলিভিশন, সিনেমা, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেট সংস্কৃতির বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে। অনেক সময় এমন বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা হয় যা সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে গ্রহণ করতে শুরু করে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে মানুষের জীবনধারা পরিবর্তিত হয়েছে, তবে এর মাধ্যমে অপসংস্কৃতির বিস্তারও ত্বরান্বিত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বেড়েছে এবং মানুষ দ্রুত পরিবর্তনশীল সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এতে অনেক ক্ষেত্রেই অপসংস্কৃতির উপাদান প্রবেশ করছে।
ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও এই প্রভাব সুস্পষ্ট। অতীতে যেসব পোশাক অশোভন বলে মনে করা হতো, বর্তমানে তা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বিনোদন মাধ্যমের প্রভাব, বিজ্ঞাপনের কৌশল এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির কারণে অনেক নতুন ফ্যাশন ট্রেন্ড প্রচলিত হয়, যা ধীরে ধীরে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। সংগীতের ক্ষেত্রেও সময়ের সাথে বড় পরিবর্তন এসেছে। অতীতে যে গানগুলো শুদ্ধ সংগীত হিসেবে বিবেচিত হতো, আজ তার স্থান দখল করেছে এমন গান, যেখানে গুণগত মানের অভাব স্পষ্ট। গানের ভাষা ও চলচ্চিত্রের উপস্থাপনার ধরন পরিবর্তিত হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতে এমন বিষয়বস্তু প্রচার করা হয় যা কিশোর-কিশোরী ও তরুণ সমাজকে নেতিবাচক পথে পরিচালিত করতে পারে। বর্তমান সমাজে সম্পর্কের সংজ্ঞা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। একসময় পারিবারিক বন্ধনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু এখন ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ক্যারিয়ারের গুরুত্ব বৃদ্ধির কারণে সম্পর্ককে হালকাভাবে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। বিবাহ বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি, লিভ টুগেদারের স্বীকৃতি এবং একাধিক সম্পর্কের ধারণা এখন প্রায় সাধারণ হয়ে উঠেছে। এ ধরনের পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতার অংশ হিসেবে দেখা হলেও, এটি সামাজিক অবক্ষয়ের দিকেও ইঙ্গিত করে। যেখানে পরিবার, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব হারাচ্ছে। প্রযুক্তির প্রভাব সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে শিক্ষা, বিনোদন এবং ব্যবসায় উন্নতি হয়েছে। তবে এর সাথে কিছু নেতিবাচক দিকও যুক্ত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে ভুয়া তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে পড়ছে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অশ্লীল বিষয়বস্তুর সহজলভ্যতা তরুণদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবন এখন উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে, যা সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একটি সমাজের মূল্যবোধ নির্ধারণ করে তার ভবিষ্যৎ গতিপথ। তবে বর্তমান সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। যে বিষয়গুলো একসময় ভুল বলে গণ্য হতো, সেগুলো কীভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠল? এই পরিবর্তনের পেছনে গণমাধ্যম, প্রযুক্তির প্রভাব, অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও সামাজিক চাপ কাজ করছে। অপসংস্কৃতির কারণে পরিবারে দূরত্ব বেড়েছে, সম্পর্কের স্থায়িত্ব কমেছে, ভোগবাদী মানসিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সামাজিক সংহতি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সমাজ যদি অপসংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তবে এটি ভবিষ্যতে নতুন সামাজিক নিয়ম হয়ে উঠতে পারে। এজন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। অপসংস্কৃতির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। স্কুল-কলেজে নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে তরুণ প্রজন্ম সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা পায়। বিনোদন ও গণমাধ্যমকে অবশ্যই তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, যাতে তারা নেতিবাচক বিষয়বস্তু প্রচার না করে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা জরুরি, কারণ পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার জন্য পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল, এটি স্বাভাবিক। তবে পরিবর্তন যদি সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি করে, তবে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। অপসংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার ভবিষ্যতে সমাজের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তাই আমাদের এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হবে যেখানে পরিবর্তন হবে ইতিবাচক, মূল্যবোধ থাকবে অটুট এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ সংস্কৃতির ভিত গড়ে উঠবে।
প্যানেল