ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২ বৈশাখ ১৪৩২

অপরিকল্পিত নগরায়ণে হুমকিতে ঢাকাবাসী

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

অপরিকল্পিত নগরায়ণে হুমকিতে ঢাকাবাসী

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র। তবে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অব্যবস্থাপনা, দুর্বল নীতিমালা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে এ মহানগরী এখন নানাবিধ সংকটে জর্জরিত। বসবাসযোগ্য শহরের সূচকে ঢাকা বহু বছর ধরেই পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নস্তরের শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে। এই বাস্তবতা শুধু পরিসংখ্যানের বিষয় নয়, নগরবাসীর প্রতিদিনের জীবনের ভোগান্তিতেও তা প্রতিফলিত হচ্ছে।
ঢাকা শহরের জনসংখ্যা প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ লাখ করে বাড়ছে। গ্রাম থেকে শহরে উন্নত জীবনের আশায় মানুষ প্রতিনিয়ত ছুটে আসছে। যার ফলে শহরের ওপর তৈরি হয়েছে তীব্র চাপ। বর্তমানে  ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটির বেশি।  অথচ জনসংখ্যার তুলনায় ঢাকার আবাসন, স্বাস্থ্য, পানি, স্যানিটেশন বা পরিবহন অবকাঠামো পর্যাপ্ত নয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, অব্যবস্থাপনার মধ্যে গড়ে ওঠা আবাসন ব্যবস্থা। ঢাকায় গড়ে ওঠা নতুন বহুতল ভবনগুলো প্রায়ই নির্মাণ কোড মানছে না। অন্যদিকে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য নেই যথেষ্ট পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প। ফলে তারা বাধ্য হয়ে বস্তিতে বসবাস করছে। বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ৫ হাজারের বেশি বস্তি রয়েছে, যেখানে লাখ লাখ মানুষ অমানবিক পরিবেশে বাস করছে। নেই পর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন, বিশুদ্ধ পানি বা স্বাস্থ্যসেবা।
প্রতি বছর বর্ষাকাল এলেই ঢাকার রাস্তাঘাট জলাবদ্ধতায় অচল হয়ে পড়ে। একদিকে খাল ও জলাশয় ভরাট, অন্যদিকে নালার অকার্যকরতাÑ এই দুই মিলিয়ে শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ঢাকায় একসময় ৫৬টি খাল ছিল। কিন্তু এখন অধিকাংশ খাল দখল ও ময়লায় ভরাট হয়ে গেছে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্ষার সময় ঘণ্টা খানেক বৃষ্টিতেই নগরবাসী দুর্ভোগে পড়ে।
ঢাকার আরেকটি পুরানো সমস্যা হলো ভয়াবহ যানজট। গণপরিবহনের অভাব, সড়ক নেটওয়ার্কের দুর্বলতা, অবৈধ পার্কিং এবং রাস্তার দখল যানজটের প্রধান কারণ। এক গবেষণা অনুযায়ী, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতি বছর প্রায় ৩-৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়। মানুষকে গড়ে প্রতিদিন ২-৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সড়কে কাটাতে হয়। যা কর্মঘণ্টা নষ্ট করে এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর। বিশেষ করে শীতকালে বায়ুদূষণের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, তা শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ঢাকায় বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হলো ইটভাঁটি, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণ সামগ্রীর ধুলাবালি এবং শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ। পাশাপাশি দূষিত পানির ব্যবহার এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে কলেরা, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, ডেঙ্গুর মতো রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিজনের জন্য কমপক্ষে ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা থাকা উচিত। অথচ ঢাকায় এই হার ১ বর্গমিটারের নিচে। প্রতিনিয়ত খেলার মাঠ, উদ্যান, পার্ক ভরাট করে স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই। ফলে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সবুজ গাছপালার অভাবে শহরের তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে, যা নগরজীবনে আরও অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করছে।ঢাকায় নগর ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য রয়েছে রাজউক, সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ একাধিক সংস্থা। কিন্তু এদের মধ্যে নেই কোনো কার্যকর সমন্বয়। এক সংস্থা রাস্তা কাটে, আরেক সংস্থা মেরামত করে; কেউ জানেই না অন্য কেউ কী করছে। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি শহর পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করছে।নদী-খাল-জলাশয় দখল এবং সরকারি জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ এখন সাধারণ ব্যাপার। অনেক সময় এসব দখলের পেছনে থাকে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। দুর্নীতির মাধ্যমে নকশা পরিবর্তন করে বহুতল ভবন তৈরি, সরকারি জমি বন্দোবস্ত নেওয়া ও পরিবেশ বিধি লঙ্ঘন করে প্রকল্প অনুমোদনের ঘটনা অহরহ ঘটেই চলছে। এর ফলে শহরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও নিরাপত্তা উভয়ই পড়েছে হুমকির মুখে।
ঢাকা শুধু একটি শহর নয়, এটি লাখো মানুষের জীবনের অংশ। এই শহরকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নাগরিক সচেতনতা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ধারাকে রুখতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা শুধু বসবাসের অযোগ্যই হবে না, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেও থমকে দেবে। তাই এখনই সময়, ঢাকার ভবিষ্যৎ রক্ষায় সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার।
চম্পা আক্তার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×